রমণীর খপ্পরে

মনিরুজ্জামান মুন্না
শনিবার, ২১ আগস্ট, ২০২১


মাহিনুল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মাঝারি পদে চাকরি করেন। বয়সেও পূর্ণ যুবক, চাকরির বয়সও বেশি না, সবে তিন বছর। চাকরিটা পেয়েই তিন বছরের প্রেমিকার সঙ্গে বিয়েটা সেরে নিয়েছেন। বুঝাপড়া আগেই শেষ সুতরাং বছর গড়াতেই ফুটফুটে মেয়ের বাবা হয়েছেন তিনি। মেয়ের নাম রেখেছেন মাহিয়া মাহি। মাহির বয়স প্রায় দুই বছর, বাবা বাবা বলে ডাকতে পারে, ভাঙা ভাঙা শব্দে মাহিনুলের সাথে কথাও বলে সে। ইমুতে বাবা মেয়ে কত কথাই বলে এখন। মাহিনুলের সব ধ্যানজ্ঞান এখন তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে। মাহিনুলের প্রেমিকা স্ত্রী মাঝে মাঝে খুনসুটি করে বলেও ফেলে, আমার ভালোবাসা বুঝি চুকিয়ে গেলো? আর আমাকে ভালোবাসো না আগের মতো। ফোনে কথা বলার সময় মেয়ের কান্নার আওয়াজ পেলে স্ত্রীর সাথে রাগারাগিও করে- মেয়েটা কাঁদবে কেন? সব আবেগ এখন মাহির প্রতি। সব স্বপ্ন ঘুরপাক খায় তার কন্যাকে ঘিরে।

ঈদে নাড়ীর টানে বাড়ি যাবে মাহিনুল। তার মেয়েকে দুই মাস দেখে না, আদর করতে পারে না, কোলে নিতে পারে না, কি কষ্ট তার বুকে। বেতন পেয়েই মেয়ের জন্য যেখানে যা পেয়েছে কিনে নিয়েছেন। তার ঈদ যেনো শুধু তার মেয়েকে ঘিরে। ব্যাগ গুছিয়ে খুব সকালে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে এসে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েছেন। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে টিকিট পেতে দেরি দেখে। ঈদের সময় কত রকম উটকো ঝামেলা যে বাস স্টেশনে হয় সবাই জানে। কেউ এসে লাইনের ফাঁকে ঢুকতে চায়। কেউ এসে দালাল ধরে টিকিট ম্যানেজ করে। বাড়তি ভাড়ার চাপ তো আছেই। মাহিনুল বাড়ি যাবে, তার মেয়ের সাথে ঈদ করবে, মেয়ের জন্য যা যা কিনে ব্যাগ বোঝাই করেছে সেটাই বারবার লক্ষ্য করছে। 

দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। এক যুবতি এসেছে পুরাই সাটামসুটাম, সানগ্লাস কপালে তোলা। চারপাশ কাঁপিয়ে লাইনের শেষে না গিয়ে কি বুঝে মাহিনুলের কাছে এসেই তাকে জিজ্ঞেস করলো, “আই থিংক ইউ আর লাস্ট ওয়ান, রাইট?” মাহিনুলের উত্তরের অপেক্ষা না করেই হুলুস্থুল রমণী বলতে শুরু করলো, “আমি আপনার পিছনে আছি, আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না, ওখানে বসবো। আমি আপনার পরেই টিকিট নিবো।” মাহিনুল কিছু বলার আগেই তরুণী গিয়ে চেয়ারে বসলো। লাইন সামনে এগিয়ে আসছে, দুই একজন পরেই মাহিনুলের পালা। সেই তরুণী সুইংগাম চিবুতে চিবুতে আবার হাজির, “এক্সকিউজ মি ভাইয়া, কিছু মনে না করলে দুইটা টিকিট কেটে নিলে আমার উপকার হতো।” কিছু বুঝে উঠার আগেই হাজার টাকার নোট ধরিয়ে মিষ্টি  হেসে থ্যাংকস বলে আবার গিয়ে চেয়ারে বসলো। মাহিনুলের পিছনের যাত্রী মুচকি হেসে বলে, “ভাই, কপাল ভালো আজকে আপনা! দারুণ চিপায় পড়ছেন। তুফান না নাড়া দিয়ে ভালোয় ভালোয় কেটে দেন।

মাহিনুল টাকা দিয়ে দুইটা টিকিট চাইলো, পাশাপাশি দুইটা সিট দিলো, মাহিনুল দাঁড়িয়ে চিন্তা করতেছে, কি আপদ এসে জুটল, এটা পাশে বসলে তো সারাপথ জ্বালিয়ে মারবে। কাউন্টারের লোক দিলো ঝাড়ি, “ঐ মিয়া, চাপেন না, পিছনের জনকে আসতে দেন”। মাহিনুল বললেন, “ভাই, দুইটা সিট দুই জায়গায় দেয়া যায় না?” কাউন্টার থেকে বলে, “ঐ মিয়া ভিড়ের সময় মজা লন?” অগত্যা কথা না বাড়িয়ে মাহিনুল সিটে এসে বসলেন। কানে ফোন রেখে টুকটাক ইংরেজি বলতে বলতে ললনা এসে হাজির, কথা না বলেই হাত বাড়িয়ে টিকিট নিয়ে মুচকি হাসি দিলো। এতো সহজে টিকিট পাওয়ার সংবাদটা ফোনের অপরপ্রান্তে পৌঁছে দিলো। “না না, লাইনে দাঁড়াতে হয় নি, একটা কিউট ভাইয়া কেটে দিয়েছেন।” বলেই কলকলিয়ে হেসে উঠলো।
 
মাহিনুলও ফোন নিয়ে ব্যস্ত, ললনার হাসি দেখার টাইম কই? “আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, টিকিট পেয়েছি, চিন্তা করো না, নিরাপদেই চলে আসবো। বাবু কি করে? বাবুর দিকে খেয়াল রেখো, আচ্ছা ঠিক আছে খেয়ে নিবো নে। তুমি টেনশন করো না। আচ্ছা রাখি।”  ফোন কেটে আবার ব্যাগ দুইটার দিকে খেয়াল করলো। এক ঘণ্টা দেরি হলেও বাস চলে এসেছে দেখে মাহিনুলর চোখ খুশিতে টগবগিয়ে উঠলো, দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠে বসেছেন।  পেছনে সেই তরুণী, বললো, “ভাইয়া, আপনি জানালার পাশেই বসেন, এসি বাসে জানালা খোলা যায় না, আমার দমবন্ধ লাগে।” মাহিনুল কথা বাড়াতে চায় না, উটকো ঝামেলা মেনে নিয়েই যাত্রা শুরু করলো। রমণী জিজ্ঞেস করলো, “ভাইয়া আপনি কোথায় নামবেন?”

লাস্ট স্টেশন বলেই মাহিনুল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। আলাপ জমাতে না পেরে সে নিজেও কানে হেডফোন দিয়ে মাথা নাড়ছে আর জাবরকাটছে। যাত্রা বিরতির ঘোষণা আসলো, “সম্মানিত যাত্রীগণ, ২০ মিনিট যাত্রাবিরতি, দ্রুত সময়ে সকলে ব্যক্তিগত কাজ সেরে বাসে ফিরে আসবেন। টাকা পয়সা, গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু গাড়িতে রেখে যাবেন না। ধন্যবাদ।” মাহিনুল বের হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো, পাশের মেয়েটিও বের হলো। মাহিনুল রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে, মেয়েটি দুইটা চিপ্স নিয়ে গাড়িতে উঠেছে। মাহিনুল এসে দেখে মেয়েটি বসে বসে চিপ্স খাচ্ছে। সে তার সিটে গিয়ে বসলো, আগে কিনে রাখা পানির বোতলটা সামনের সিটের পিছনে ছিলো । মাহিনুল বোতল খুলে পানি পান করলো। মেয়েটা ফোন হাতে নিয়ে রাজ্য জয়ের সন্তুষ্টির মুচকি হাসি হাসলো। কারো সাথে আধো বাংলা আধো ইংরেজিতে কি জানি বললো। যে কয়টা শব্দ বুঝা গেলো তা ছিলো- “আর বেশিক্ষণ লাগবে না, সামনের স্টেশনে থাকেন। সব কিছু ঠিকঠাক হচ্ছে, আরো কী কী জানি কথা বললো বাংলিশে।

সামনের স্টেশনে নেমে গেলো মেয়েটি, রাত তখন তিনটা। বাস লাস্ট স্টেশনে এসে পৌঁছেছে ভোর পাঁচটায়, সবাই নেমে গেছে, মাহিনুল একাই ঘুমাচ্ছে, গভীর ঘুম, সুপারভাইজার এসে ডাকছে, “ঐ ভাই, আর কত ঘুমাবেন? বাড়ি গিয়া ঘুমান, নামেন নামেন।” মাহিনুলের খবর নেই, ঘাড় বাঁকা করে পরে আছে। সুপারভাইজার আবার ডাকে- “ঐ মিয়া, গাড়ি ঘুরামু, নামেন না কেন? সারা না পেয়ে সন্দেহ হলো তার। মাথাটা তুলে দেখে চোখ মুখ অস্বাভাবিক, লালা ঝরছে মুখ দিয়ে। সুপারভাইজার ড্রাইভারকে ডাকলো, “উস্তাদ, ঘটনা ঘইটা গেছে, এই লোক তো অজ্ঞান।” হেল্পার, ড্রাইভার মিলে ধরে নিচে নামালো, নিথর দেহ, শুইয়ে রেখেছে রাস্তার পাশে। হেল্পার বলে, উস্তাদ, পুলিশ আসলে কী গেঞ্জামে পড়ি আবার, ভয় লাগতেছে, মালিকরে ফোন দেন।
 
“আরে হালার পুত চুপ কর, আমি দেখাতাছি কি করন যায়” ড্রাইভার ধমক দিলো। এর মাঝে আশেপাশের আরো কিছু মানুষ জমেছে, কেউ মাথায় পানি দিলো, কেউ কেউ ছবি  তুলতেছে, কেউ ভিডিও করতেছে। “আহারে মলম পার্টির পাল্লায় পড়ছে, কিছু খাওয়াইছে, দেহেন না, মুখ দিয়া লালা পড়তাছে?” “কই যাইবো কি জানি? মানিব্যাগ, মোবাইল কিছুই নাই, কেমনে খবর দিমু বাসায়?” সুপারভাইজারকে ডাক দিয়ে ড্রাইভার বললো, “দেখতো গাড়িতে ব্যাগ ট্যাগ কিছু আছে নি?” সুপারভাইজার গাড়িতে খুঁজে এসে জানালো, সামনে থাকা পানির বোতলটা ছাড়া কিছুই নাই। 
পাশ থেকে একজন বললো, “ভাই, এভাবে শুয়াইয়া রাইখা লাভ নাই, আশেপাশে কোনো হাসপাতালে নিয়া চলেন, মানুষটা আগে বাঁচুক, পরেরটা পরে দেহা যাইবো...।”