বাসায় বসে আছেন। খাবার সামনে এল। তা দেখেই আপনার রসনা সিক্ত হয়ে গেল। কিংবা রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন। দুইপাশে সারি সারি খাবারের দোকান। সেখানে তৈরি হচ্ছে বিচিত্র পদের খাবার। বাতাস সেসব খাবারের সুঘ্রাণ বয়ে নিয়ে আসছে। আর আপনার নাসারন্ধ্রে তা সুড়সুড়ি দিচ্ছে। খাবারের ঘ্রাণে মাতোয়ারা হচ্ছে মন। এজন্যই বলা হয় 'ঘ্রাণং অর্ধং ভোজনং'। অর্থাৎ, ঘ্রাণেই অর্ধেক ভোজন হয়ে যায়। আর খাবারে রসনাবিলাসী এ স্বাদ এবং মন উচাটন করা এ ঘ্রাণ যুক্ত করে বিভিন্ন প্রকারের মসলা। আদিকাল থেকেই মানুষ খাবারে নানা মসলা ব্যবহার করেছে। মসলা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। এখনো চালাচ্ছে। এমনকি মসলা নিয়ে মানুষ যুদ্ধও করেছে। কালক্রমে মসলার চাহিদা কোনো অংশে তো কমেইনি, বরং তা উত্তরোত্তর বাড়ছে। বর্তমানে বিশ্বে প্রচলিত সবচেয়ে দামি পাঁচটি মসলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এখানে তুলে ধরা হলো।
জাফরান
খ্রিস্টপূর্ব ষোল শতকে প্যাপিরাস পাতায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সে সময় রোগ সারানোর জন্য জাফরান ব্যবহার হতো। মনোবৈকল্য, ঘা ও পুঁজযুক্ত ক্ষত সারাতে প্রাচীন চিকিৎসকরা এটি ব্যবহার করতেন। খ্রিস্টপূর্ব চার শতকে কিংবদন্তি গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে জাফরান ব্যবহারের পরামর্শ দিতেন। ফিনিশীয়দের মধ্যেও এর ব্যবহার ছিল। কালক্রমে জাফরানের আরো নানাবিধ ব্যবহার প্রচলিত হয়। প্রাচীন রোমে থিয়েটারে আগত উচ্চপদস্থ অতিথিদের সতেজ করতে তাদের ওপর জাফরান ছিটানো হতো। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চলার পথে জাফরান ছিটিয়ে রাখার রেওয়াজ ছিল। এমনকি বাসর সাজাতেও জাফরানের বহুল প্রচলন ছিল। রঞ্জক হিসেবে জাফরানের ব্যবহারও বেশ প্রাচীন। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে কনের ওড়না জাফরান দিয়ে রাঙানো হতো। চৌদ্দ ও পনেরো শতকে জাফরান বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল ভেনিস। জাফরানে ভেজাল মেশানোর কারণে ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। এমনকি অসাধু ব্যবসায়ীদের মৃত্যুদণ্ডও দেয়া হতো। জাফরানের গুণগত মান পরীক্ষা করার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হতো। এভাবে প্রাচীনকাল থেকে জাফরান নানাভাবে ব্যবহৃত হয়ে কালক্রমে মসলা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে দামি মসলা এটি। একে স্যাফ্রনও বলা হয়। অনেক জায়গায় এ মসলা কেশর নামেও পরিচিত। ক্রোকাস নামক একটি ফুলের গর্ভদণ্ড থেকে এটি সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি ফুল থেকে সর্বোচ্চ তিনটি জাফরান পাওয়া যায়। এক কেজি জাফরান সংগ্রহ করতে প্রায় দেড় লাখ ফুল প্রয়োজন। জাফরানের এ দুষ্প্রাপ্যতা তাকে বিশ্বের সবচেয়ে দামি মসলায় পরিণত করেছে। গুণগত মান সাপেক্ষে প্রতি কেজি জাফরানের দাম দুই-আড়াই লাখ টাকা। দামের দিক দিয়ে এটি স্বর্ণের সঙ্গে তুলনীয়। তাই একে 'রেড গোল্ড' বলা হয়।
এলাচ
বিশ্বের অন্যতম দামি মসলা এটি। এলাচ খাবারের মধ্যে চমৎকার ঘ্রাণ ও স্বাদ যুক্ত করে। মসলাটি প্রধানত ভারতবর্ষ ও মাদাগাস্কারে চাষ হয়। দুই ধরনের এলাচ আছে। কালো ও সবুজ। কালো এলাচের স্বাদ কটু। সুস্বাদু খাবারকে সুবাসিত করার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়। আর সবুজ এলাচ সাধারণত মিষ্টান্নে ব্যবহার করা হয়।
গোলমরিচ
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মসলার মধ্যে এটি অন্যতম। শত শত বছর ধরে ব্যয়বহুল মসলাগুলোর একটি হিসেবে গোলমরিচ তার অবস্থান ধরে রেখেছে। এর আদিভূমি ভারত। তবে বর্তমানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও ব্রাজিলে গোলমরিচের চাষ করা হয়। গোলমরিচ বছরে দুবার সংগ্রহ করা যায়।
দারচিনি
দারচিনি গাছের বাকল। ইংরেজি নাম সিনামন। বিশ্বে এটি জনপ্রিয় একটি মসলা। দুই ধরনের দারচিনি আছে। চীন ও ইন্দোনেশিয়ায় জন্মানো দারচিনি 'ক্যাসিয়া সিনামন' নামে পরিচিত। আর শ্রীলংকা, সিসিলি ও মাদাগাস্কারে জন্মানো দারচিনিকে বলা হয় 'সিলন সিনামন'। সিলন সিনামনের দাম ক্যাসিয়া সিনামনের তুলনায় অনেক বেশি।
কালিজিরা
এর স্বাদ কিছুটা মিষ্টি। পিঠা, সবজি ও মাংসকে সুবাসিত করার জন্য কালিজিরা ব্যবহার করা হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্রঙ্কাইটিস, বাত ও অ্যাজমার চিকিৎসায় কালিজিরা ব্যবহার করা হয়।