শেখ মুজিব: তাঁকে যেমন দেখেছি
তখন তাঁর নাম উচ্চারণে ছিল অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। যে নায়ক দেশের জন্য, জনগণের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে এসেছেন, যার নামে পরিচালিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ সেই মানুষটির নাম নেওয়া যাবে না! এমন এক ভয়ার্ত, নিস্তব্ধ, বোবা সময়ে সাইরেন বাঁজিয়ে সেই নাম উচ্চারণ করেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজল। আর তিনি যার নামটি উচ্চারণ করেছিলেন সেটি আর কেউ নন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাঁর নাম উচ্চারণ করাকে তৎকালীন অবৈধ শাসকরা অপরাধ হিসাবে গণ্য করত। সেই কঠিন সময়ে যখন আওয়ামী লীগ কিংবা বঙ্গবন্ধু’র অনুসারীদের জীবনে নেমে এসেছিল অন্ধকার, সে সময়ে কোন ধরণের রাখঢাক না করে সরাসরি বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে আস্ত একটা বই প্রকাশ করে বসেন আবুল ফজল।
১৯৭৮ সালের নভেম্বরে বইটি প্রকাশের আগের বছর তা সাপ্তাহিক ‘মুক্তবাণী’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশও করেন। ‘শেখ মুজিব: তাঁকে যেমন দেখেছি’ স্মৃতিকথাধর্মী এ বইটি ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাঁকে নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহল থেকে লেখা প্রথম কোন বই। বর্তমানে সেই বইটিকে সব্যসাচী হাজরার আঁকা প্রচ্ছদে নতুন করে প্রকাশ করছে চট্টগ্রামের বাতিঘর প্রকাশনী।
১১৯ পৃষ্ঠার বইটিতে আবুল ফজল সেই সময়কার পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘‘এত বড় একটা দ্বিতীয় কারবালা ঘটে গেল দেশে.... সে সম্পর্কে দেশের সর্বাপেক্ষা সচেতন অংশ শিক্ষিত আর বুদ্ধিজীবী সমাজ কিছুমাত্র বিচলিত বোধ করছে না, এ ভাবা যায়।...কবিরা একটানা অতি নিরশ ও নিষ্প্রাণ প্রেমের বা ‘আমি-তুমি’ মার্কা কবিতা লিখে চলেছেন।” তিনি আহ্বান করেছেন, “আমাদের সামনে আজ এমন কোন মহৎ কবি নেই, যে কবি বাংলাদেশের অন্তরের এ নীরব কান্নাকে ভাষায় কিংবা ছন্দে রূপ দিতে পারেন।”
বঙ্গবন্ধুর ঘাতক সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ট সরকারের সময়ে তিনি দৃঢ় বাক্যে লিখেছেন, “বাংলাদেশে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও সর্বাধিক উচ্চারিত নাম শেখ মুজিবুর রহমান।” ‘কৈফিয়ৎ’ শিরোনামে বইটির ভূমিকায় আবুল ফজল উল্লেখ করেছেন, বইটিতে লেখক তার আবেগগুলো তুলে ধরলেও সজ্ঞানে মিথ্যা দিয়ে অতিরঞ্জনের আশ্রয় নেননি। বইয়ের ভূমিকাতে তিনি বলেছেন, ‘‘এতখানি সুযোগ-সুবিধা পেয়েও তিনি কেন জাতিকে যথাযথ নেতৃত্ব দিতে পারলেন না, তা জানার এবং জেনে তার থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন রয়েছে সবার।’’
তিনি তার কলেমে তুলে ধরেছেন ‘‘শেখ মুজিব প্রশাসক হিসেবে কিছু ভুল করেছেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিশ্বস্ত কারো অপরাধকে হয়তো তত গুরুত্ব দেননি। যোগ্যতা আর সিনিয়রিটি কখনো অগ্রাহ্য হয়েছে।...এসব অভিযোগ দিনে দিনে তাঁর বিরুদ্ধে স্তূপীকৃত হয়েছে। ...সামরিক বাহিনীতে ভিতরে ভিতরে গড়ে ওঠা বড় রকমের অসন্তোষ হয়তো এতে মদদ যুগিয়েছে।...যাই হোক, এ এক মহাসত্য যে দোষে গুণেই মানুষ। কোন নেতৃত্বই সম্পূর্ণ নির্দোষ নয়।”
বাঙালির স্বাধীকার আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিব যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাই তিনি সশরীরে উপস্থিত না থাকলেও তাঁর নাম যাদুমন্ত্রের মত কাজ করেছে। আবুল ফজল লিখেছেন, “যারা মনে করেন তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনকাল সম্পূর্ণ ব্যর্থ, তারা তো এ সময়টুকু বাদ দিয়ে তাঁর আগের জীবন ১৯৭২-এর পূর্ব পর্যন্ত তিনি দেশের জন্য যা করেছেন তার বিচার করে তাঁর মূল্যায়ন করতে পারেন।...যুদ্ধপরবর্তী বিশৃঙ্খল দেশ শাসনে কিছু ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকলে তার জন্য বড্ড বেশি মূল্য দিতে হয়েছে তাঁকে।”
কিন্ত স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার জন্য কি কেবলই মুজিব দায়ী? তিনি কি চেষ্টা করেননি? এ বিষয়েও বইটি থেকে পাঠক ধারণা পাবেন। যেমন- এক সাক্ষাৎকালে মুজিব লেখককে বলছেন, ‘‘কী করি, কোথাও তো ভাল লোক পাচ্ছি না। যাকে যেখানে বসাই সে-ই চুরি করে। অবস্থাপন্ন ঘরের শিক্ষিত ছেলেদের বেছে বেছে নানা কল-কারখানায় প্রশাসক বানালাম, দু’দিন যেতে না যেতে তারাও চুরি করতে শুরু করলো। যাকে পাই বলি, কিছু সৎ লোক খুঁজে বেড়াচ্ছি।”
২.
শেখ মুজিবের সঙ্গে লেখকের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ২০ মার্চ ১৯৭৩। স্বাধীনতার আগে তাদের একে অপরের সঙ্গে কখনোই দেখা হয়নি। তবে শেখ মুজিব স্বাধীনতার আগে(১৯৬৯) আবুল ফজলকে তার সাহসী লেখনীর জন্য চিঠি লিখেছিলেন। চট্টগ্রামে একবার দেখা করার কথাও ছিল, একে অপরের আস্তানায় ঢুঁ মেরেও ঘটনাচক্রে তাদের দেখা হয়নি। তবে দেশ স্বাধীনের পর ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে এলে তাঁর সম্মানে যে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছিল তাতে আবুল ফজলকে নিমন্ত্রণ করতে ভুল করেননি শেখ মুজিব। এরপর যতবারই লেখক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছেন প্রতিবারই তিনি দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলেছেন, সতর্ক করেছেন। বঙ্গবন্ধু আবুল ফজলকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর নানা প্রয়োজনেই তাদের মধ্যে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ ঘটেছে। প্রতি সাক্ষাতেই লেখক তার আলোচ্য বিষয়ের বাইরে বঙ্গবন্ধুকে নানাভাবে পরামর্শ দিয়েছেন।
আবুল ফজল লিখেছেন, ‘‘স্বার্থান্বেষী অবুঝ আত্মীয় স্বজনেরা অসাধারণ প্রতিভাধর নেতৃত্বের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ক্ষেত্রে নেতারা যে নিন্দাভাজন হন তার মূলে এ ধরনের আত্মীয়স্বজনদের কার্যকলাপ কম দায়ী নয়।” বঙ্গবন্ধুকে তিনি এ.কে ফজলুল হক ও খাজা নামিউদ্দীনের উদাহরণ টেনে বলেছেন তাদেরকে আত্মীয়রাই ডুবিয়েছেন। লাল বাহিনীর দৌরাত্ম্যের কথাও বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সে সব বিষয়ে নির্দেশনাও দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের স্বার্থ হাসিলে মরিয়া মধ্যবিত্ত ও রন্ধে রন্ধে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা একা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
এই প্রসঙ্গে লেখকের একটি বিশ্লেষণ টেনে আনা যায়। মুনীর চৌধুরী লেখককে কথাচ্ছলে বলেছিলেন, ‘দেখুন, আমি মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, সুযোগ পেলে আমি উপরে উঠতে চাইবো, এ তো খুবই স্বাভাবিক।’ শেখ মুজিব এবং তার সহকর্মী আর মন্ত্রীসভার সদস্যরা সবাই মধ্যবিত্ত ঘর থেকেই এসেছেন উল্লেখ করে লেখক মধ্যবিত্তের বেঈমানীর একটি নজির হাজির করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘মধ্যবিত্তের এ স্বভাব-দুর্বলতার জন্যই বোধ করি শেখ মুজিবের দীর্ঘদিনের স্নেহপুষ্ট বিশ্বস্ত অনেক সহকর্মীর পক্ষে তাঁর রক্তাক্ত স্মৃতির উপর দাঁড়িয়ে মন্ত্রিত্বের শপথ গ্রহণ সম্ভব হয়েছে।’’
১৫ আগস্টের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর। সেই অনুষ্ঠানে কি ঘোষণা দিতেন? কি সুখবর দিতেন শিক্ষার্থীদের, কি উৎসাহ দিতেন শিক্ষকদের সে সম্পর্কেও লেখক তার বইয়ে কিছু তথ্য জানিয়েছেন। আর দায়িত্ব নেওয়ার ১৫ মাস ধরে কোন বেতন না নিয়ে কি করে দুপুরের খাবার খেতেন সে বিষয়েও লেখক তুলে ধরেছেন।
শুধু বঙ্গবন্ধুই নন বেশিরভাগ মানুষ চিন্তাও করতে পারেনি বাঙালিরা শেখ মুজিবকে হত্যা করবে। আর বঙ্গবন্ধুকে এ বিষয়ে কোন সতর্ক করা হলেও তিনি তা কানেই তুলতেন না। এই প্রসঙ্গে বার্নার্ড শ’র উক্তি টেনে লেখক শেখ মুজিব সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘‘It is dangerous to be too much confident."
বইয়ের ৪৮ পৃষ্ঠায় ট্যানারি ও কোরবানির চামড়ার দাম কমে যাওয়া নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা যা আজও সমসাময়িক মনে হবে। ১০০ পৃষ্ঠায় শেখ কামালকে নিয়ে স্মৃতিচারণ, ৯১ পৃষ্ঠায় সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কেমন ব্যক্তির সভাপতিত্ব করা উচিত এমন বহু বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
যিশুখ্রিস্টকে হত্যার পাপের বোঝা ইহুদিরা আজো বয়ে বেড়াচ্ছে শেখ মুজিব যিশু ছিলেন না কিন্তু ছিলেন মানুষ। বাঙালিরা স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পাপ কত দিন বয়ে বেড়াবে সে প্রশ্নের উত্তর কে জানে!
আরও পড়ুন আপনার মতামত লিখুন