বিতর্ক + বিনয় = বড় মানুষ

এম.এস.আই খান
বৃহস্পতিবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০২৩


পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশে বিতর্ক চর্চার ইতিহাস প্রায় শত বছর হতে চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দশকেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে আল-মামুন ডিবেটিং ক্লাব (সূত্র: মুসলিম হল ইউনিয়নের বার্ষিক প্রতিবেদন ১৯২৬-২৭)। বাংলাদেশের প্রথম এ বিতর্ক সংগঠনটির ধারাবাহিকতা রক্ষা না পেলেও বিতর্ক আন্দোলন থেমে ছিল না। ভাষা আন্দোলন ও তার পরবর্তী সময়ে দেশের বাইরে গিয়েও বিতর্ক চর্চা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

কার্জন হলে বিশেষ প্রদর্শনী বিতর্কের আয়োজন করা হত যেখানে উপাচার্য উপস্থিত থাকতেন। আল-মামুন ক্লাব কেন ধারাবাহিকতা পেল না সেই ইতিহাসের পাঠোদ্ধার করা না গেলেও ১৯৮২ সাল থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির যাত্রা ও সংগঠনটির পরবর্তী অগ্রযাত্রার কথা সবার জানা। সারাদেশে শিক্ষা বিস্তারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন তার গ্রাজুয়েট ও শিক্ষকদের দিয়ে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে তেমনি বিতর্ক অঙ্গনেও অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছে।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিতার্কিদের মধ্যে যারা পেশাগত জীবনে সরকারি-বেসরকারি স্কুল,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন তারা বিতর্ক, বিতার্কিক ও বিতর্ক সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, তারকা বিতার্কিকেরা কর্মশালা থেকে শুরু করে বিভিন্ন আয়োজনে নানাভাবে যুক্ত থেকে বিতর্ক আন্দোলনকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সেই সম্মিলিত চেষ্টায় আজ দেশের প্রায় প্রতিটি ক্যাম্পাসে বিতর্ক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগঠনে পরিণত হয়েছে বিতর্ক সংগঠন।

এই জনপ্রিয়তার দিকে তাকালে বিতর্ক আন্দোলনের জয় প্রমাণিত হয়, এতে কোন সন্দেহ নেই। টেলিভিশন বিতর্কের হাত ধরে বিতর্ক এখন জনপ্রিয় ও বৃদ্ধিদীপ্ত অনুষ্ঠানগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাত ধরে বিশ্বমঞ্চেও এখন বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন। চারদিকের এই জয়জয়কার অবস্থার মধ্যে এক গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে। সারাদেশে বাংলা বিতর্ক চর্চার ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দের বহুল ব্যবহার এবং প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার অভিযোগ এখন পুরানো। প্রেক্ষাপট, চিত্রকল্প, দৃশ্যপট বা ব্যবস্থার -এর মত সুন্দর বাংলা শব্দটিকে পাশ কাটিয়ে ‘আমাদের ওয়াল্ডে, তাদের ওয়াল্ডে’ শব্দমালা এখন বেশ জনপ্রিয়। ‘এক্সিট করে না, প্যারা নাই, আইতাছে, যাইতাছে, খাইতাছে, মরতাছে’ শব্দগুলোর ব্যবহারকে বিতার্কিকরা এখন এক রকম বৈধ করে নিয়েছেন। ভাষাগত এই ব্যাধি ছাড়াও একটি বড় ব্যাধি বিতার্কিক সমাজে তৈরি হয়েছে।

এখনকার বিতার্কিকরা টানা কয়েকটি বিতর্ক উৎসবে জয় পেলে পরাজয় মেনে নেওয়ার শিক্ষা যেন ভুলে যায়। অনেকটা ‘Born to Win’ নীতিতে তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেন। কয়েকবার ডিবেটর অব দ্যা টুর্নামেন্ট হতে পারলে বিচারকদের সঙ্গে ‘অপ্রত্যাশিত আচরণ’ করা যেন ‘স্টাইলে’ পরিণত হয়। একজন বিচারক ভুল হতে পারেন, সম্মান ও ভদ্রতার সঙ্গে তাকে প্রশ্ন করা যেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন করার ‘বিশেষ টোন’ থাকে যা দ্বারা ক্ষিপ্ততা প্রকাশ পায় আরো পরিষ্কার করে বললে বেয়াদবি প্রকাশ হয়, তা কখনোই একজন ভালো বিতার্কিকের কাজ হতে পারে না। কোন বিচারক সম্পর্কে আপত্তি থাকলে বিতর্ক শুরুর আগেই তা আয়োজকদের জানানো কিংবা বিচারকের রায় পছন্দ না হলে ভদ্রতা বজায় রেখে প্রশ্ন করে কিংবা আয়োজকদের জানিয়ে তার ইতিটানা যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে— একটি বিতর্কের জয়-পরাজয়ই শেষ কথা নয়, একটি অভদ্র আচরণ একজন বিতার্কিকের বাকিটা জীবনের পরিচয় হয়ে থাকে। তাই বড় বিতার্কিক মাত্রই অপ্রত্যাশিত আচরণ করার একটা নিজস্ব স্টাইল থাকবে, এমন চর্চাটি মোটেও ভাল কিছু নয়। যুক্তির চর্চা করে যদি আমরা বিনয় ভুলে যাই তাহলে কোন ইলেকট্রিক ডিভাইসের সাথে মানুষের পার্থক্য রইলো কই? মানুষের মধ্যে সম্মান, বিনয়, শ্রদ্ধা ও স্নেহবোধ থাকবে এটিকে মেনে নিয়েই যেন আমাদের যুক্তির চর্চা হয়, বিতর্ক আন্দোলন সামনে এগোয়।

বিতর্ক আন্দোলেন আমরা বলি- ‘বিতার্কিক ও একজন ঝগড়াটের মাঝে তফাৎ গড়ে যুক্তি’। এখন সময় এসেছে এটি বলার যে, তফাৎ গড়ে যুক্তি ও বিনয়। তাই তিন ‘ব’ দিয়ে বিতর্কের মানুষদের বলব ধন্যবাদ— ‘বিতর্ক, বিনয় = বড় মানুষ’।