হল জীবনের সুখ-দুঃখ: ক্যাম্পাসের সবচেয়ে রােমাঞ্চকর অধ্যায় হলাে হল জীবন । আবাসিক ছাত্রছাত্রীদের সুখদুঃখ, হাসিকান্না, আনন্দ বেদনা সমস্ত কিছুই আবর্তিত হয় হলকে ঘিরে। প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয় হল। এক সময় পাশ করে বেরুনাের পরও হল জীবনের স্মৃতিগুলাে হৃদয়ের মানসপটে চির অম্লান হয়ে থাকে। আমার হল জীবন শুরু হয় কলেজ জীবন থেকে। এসএম হলের ১১১ নং রুমে। আবদুল মান্নান ভূঁঞা, রাশেদ খান মেননসহ অনেক নেতার আগমন ঘটত এই কক্ষে । সক্রিয় ছাত্ররাজনীতির পাশাপাশি আমি তখন কামাল লােহানী, নিজামুল হক, মনিরুল আলম, সাধন ঘােষ, শেখ লুঙ্কর রহমান, অজিত রায়ের নেতৃত্বে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে চলেছি। তারই ধারাবাহিকতায় সহসা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং অবশেষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যােগদান ।
দেশ স্বাধীন হলে জগন্নাথ কলেজের সিঁড়ি বেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বলয়ে প্রবেশ সাংবাদিকতা বিভাগ এবং শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে। শুরু হয় অন্যরকম জীবন। ছাত্র জীবনের রােমাঞ্চকর মুহূর্তের শুরু মূলত এখান থেকেই। হলে আছি, বেশ আছি। কোনাে বাধাবিপত্তি নেই। ক্লাস, আভড়া, হল ক্যান্টিনে খাওয়া দাওয়া, দল বেঁধে মিলনায়তনে টেলিভিশন দেখতে যাওয়া । প্রথমে বন্ধু জাফর সাদেকের সঙ্গে হলের মূলভবনে অনেক দিন ডাবলিং করি। তারপর পুকুর পাড়ের এক্সটেনশন হলের ১৩ নং কক্ষ হয় আমার আবাসিক ঠিকানা। কলেজ জীবনে ছিলাম বড় ভাইয়ের বাসায় অনেকটা বাধাবন্ধনে। হলেই নিজেকে স্বাধীনভাবে বিকশিত করার সুযােগ পাই।
সত্তর দশকে আমি যখন শহীদুল্লাহ হলের ছাত্র তখন একজন সেলিব্রেটি হিসেবে হলের প্রভােস্ট, হাউজ টিউটর, হল সংসদের কর্মকর্তা, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের কাছ থেকে বাড়তি সুযােগ। সুবিধা পেতাম। হলের প্রভােস্ট ছিলেন ড. আবদুল লতিফ । লতিফ স্যার অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাগী এবং মেধাবী শিক্ষক ছিলেন। সৎ এবং আপােষহীন ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই স্যারকে নিয়ে তখন সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলােচনা ছিল । কিন্তু ভেতরে ছিলেন অত্যন্ত হৃদয়বান। স্যার আমাকে স্নেহ করতেন। স্যারের বাসায় ছিল আমার অবাধ যাতায়ত । তাঁর ছেলেমেয়েদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। আমার বিয়ের পরে স্যারের পরিবারের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্যার ধীরে ধীরে আমার জীবনের একজন অভিভাবক হয়ে ওঠেন। এছাড়া হলের হাউজ টিউটর ড. মাযহারুল ইসলাম স্যার, খয়ের স্যার, সফিক স্যার, জাফর স্যার, সাহাদাৎ স্যার সবাই আমাকে সন্তানের মতাে আদর করতেন।
[ছবিতে: ৮০ দশকে টিএসসি-তে এক বিতর্ক প্রতিযােগিতায় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মাহফুজুল্লাহ, এনায়েতুল্লাহ খান, আনােয়ার জাহিদ, আক্তারুজ্জামান, নাসির উদ্দিস ইউসুফ, বেবী জামান, আব্দুল্লাহ আল মামুন, সেলিমসহ লেখক]
আমাদের হলটা ছিল ভীষণ সুন্দর । এর নান্দনিক পরিবেশ সবাইকে আকৃষ্ট করত। পাশেই কাজটাল হক হল । আর দুই হলের মাঝখানে বড় পুকুর। কত জোছনা প্লাবিত রাতে দেয় যে আমি বাঁধানাে ঘাটে বসে বাঁশি বাজিয়েছি। হলের আনাচে কানাচে ঝরা ফুল কুড়িয়েছি সে কথা মনে হবে। মন উদাস হয়ে যায় ।
অনেকদিন দলবেঁধে হলে থেকেই হেঁটে গিয়ে ডিআইটিতে অবস্থিত টেলিভিশনে গান করেছি। আবার এক সাথে হল মিলনায়তনে নিজেদের অনুষ্ঠান দেখেছি। সত্তর দশকের শুরুতে সেই তারকাখ্যাতি বেশ উপভােগ করতাম। নবীনবরণ, অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিভিন্ন হলে, টিএসসিতে ডাক পড়ত। ১৯৭৬ সালের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তখন মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান। তিনি বিভাগীয় ছাত্রদের সাংস্কৃতিক প্রতিযােগিতায় আমাকে রীতিমতাে একজন বিচারক হিসেবে উপস্থিত করলেন।
আমি ছিলাম বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য। ১৯৭৩-৭৪ সালে ঢাকা শহর কমিটির সভাপতি । একই সময় জগন্নাথ কলেজ এবং খিলগাঁও চৌধুরী পাড়া কমিটির সভাপতি। ইউনাইটেড পিপলস পাটি সমর্থিত ছাত্র সংগঠনটি তখন বেশ শক্তিশালী। একবার এই সংগঠন থেকে জগন্নাথ কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। জাতীয় রাজনীতির প্রভাব প্রতিক্রিয়া অনেক সময় হলের জীবনযাত্রার ব্যঘাত ঘটায়। অনেক সময় প্রতিপক্ষের আক্রমনের ভয়ে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। আমাদের সময় এখনকার মতাে এত সুযােগ সুবিধা ছিল না। এমন কি রুমগুলােতে কোনাে ফ্যান ছিল না। কখনও ডাবলিং, ট্রিপলিং করতে হতাে। তারপরও এখনকার চেয়ে তখন অনেক স্বস্তি ছিল।
একবার একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থীরা সপরিষদ গণসংযােগে এলাে আমাদের হলে। ভিপি পদপ্রার্থী লেনিন রুমে এসে আমার সঙ্গে করমর্দনের সময় নিজের পরিচয় দিলেন, “আমি নূহ আলম লেনিন। জবাবে বলেছিলাম, আমি ফকির আলমগীর মাও সেতুং'। বিষয়টি তখন বাকশাল বিরােধী ছাত্রমহলে বেশ আলােচিত হয়। ১৯৭৫ সালে শহীদুল্লাহ হলের নতুন ভবনের ১৩২ নং কক্ষে থাকাকালীন সময়ে ঘটে যায় ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের নানা অধ্যায়। হলে থেকেই ১৯৭৮ সালে সিলেটে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। শহীদুল্লাহ হলের ৬০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে অনেক প্রবীণ ছাত্রদের সঙ্গে অংশ নেই, গান করি। সে স্মৃতি আজও মনে পড়ে।
টিএসসি স্মৃতি
‘তবু ভালােবাসি ভালােবাসি
ভালােবাসি আমাদের ঢাকা
টিএসসি চত্বরে প্রাণের স্পন্দন আছে
বইমেলা চারুকলায় তত্ত্বনন্দন আছে’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র টিএসসি। আমাদের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এবং ডাকসুসহ কিছু পরিচিত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের শাখাগুলাের কর্মকাণ্ডে মুখর ছিল টিএসসি। পরিবেশও ছিল খুব সুন্দর। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নাটকের জমিনে যে সুন্দর ফসল ফলেছে তাতে টিএসসির অনেক অবদান রয়েছে। আজকাল আবৃত্তি চর্চায়ও কেন্দ্রটি বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। আমার শিল্পী জীবনের উত্থানের অনেকটাই জড়িয়ে আছে টিএসসি চত্বর। এখানে শেখ লুৎফর রহমান, মনুভাই আমাদের গণসঙ্গীত শেখাতেন। অজিত রায়ের পরিচালনায় কত নববর্ষ, বসন্ত উৎসবে কোরাসে কণ্ঠ মিলিয়েছি। কত আন্দোলন, সংগ্রামের গান তােলার জন্য এখানে সমবেত হয়েছি।
[বিশ্ববিদ্যালয় শােক দিবসের অনুষ্ঠানে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদের সাথে লেখক]
ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, চীনমৈত্রী সমিতিসহ অনেক প্রগতিশীল সংগঠনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া আমরা এখানে করতাম। ছাত্র জীবনে টিএসসিতে ছুটে যাওয়ার আকর্ষণ ছিল। মহড়া কক্ষে, ক্যাফেটেরিয়ায়, সুইমিং পুল চত্ত্বরে কিংবা সবুজ মাঠে। ভেতরের সবুজ দুর্বাঘাস মাঠটিকে নান্দনিক সৌন্দর্যে আলােকিত রেখেছে চিরকাল। এখনও চোখে ভাসে প্রতিদিন শেষ বিকেলে অসংখ্য তরুণতরুণীর পদচারণায় মুখরিত থাকত মাঠখানি। বন্ধুবান্ধবীদের নিয়ে এই মাঠে বসে কত আড্ডা দিয়েছি। হৈচৈ করে ক্যাফেটেরিয়ায় খেয়েছি। বিশেষ করে শীতকালে গায়ে রােদ লাগিয়ে এই সবুজ মাঠে বসতে ভালাে লাগত। একবার সুইমিং পুল সাইডে 'স্পন্দন থেকে ফিরােজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদসহ পপ সঙ্গীতানুষ্ঠান করেছি। আরেকবার মিলনায়তনে পিলু মমতাজের সঙ্গে জুটি বেঁধে গান গেয়েছি। আনন্দে মেতে উঠেছিল তরুণতরুণীরা। এই তাে সেদিনও আমার সঙ্গীত জীবনের ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ হুসনা বানু খানমের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের জন্য বেছে নিয়েছিলাম শিল্পী জীবনের সবচেয়ে প্রিয় টিএসসি মিলনায়তনটিকে। ১৯ মে ২০০৬ অনুষ্ঠিত কনসার্টে উপচেপড়া দর্শকদের ভালােবাসা আর বিশ্ববিদ্যালয় ও টিএসসি কর্তৃপক্ষের ফুলেল শুভেচ্ছা ও সম্মাননা আমাকে অভিতূত করে। যনে করিয়ে দেয় পুরানাে দিনের স্মৃতি। আমার সঙ্গীত গুরু হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সংবর্ধনা ও গণসঙ্গীতানুষ্ঠানও হয়েছিল এই মিলনায়তনে। দেবব্রত বিশ্বাসসহ আরও কত গুণী শিল্পীদের অনুষ্ঠান দেখেছি এখানে। যাদের সাথে তারুণ্যের দিনগুলােতে আড্ডা দিয়েছি তাদের অনেকে বেঁচে নেই। এখনও বিকেলে সবুজ দুর্বাঘাসে বসে তরুণতরুণীরা মুখরিত হয় গল্প, আড্ডায়। এমনি সময়ের পরিবর্তনে কখনও ব্যস্ততায় যাওয়া হয় টিএসসিতে। খুঁজে ফিরি সেই মালিকে যে আমাকে বাগান থেকে লাল গােলাপ তুলে দিত।
মধুর ক্যান্টিনের স্মৃতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমার আরেক প্রিয়তীর্থ মধুর ক্যান্টিন। স্মৃতি জড়িয়ে আছে ১৯৬৬ সাল থেকে। জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় থেকেই শুরু হয় আসা যাওয়া। প্রগতিশীল রাজনীতির বলয়ে প্রবেশ করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সক্রিয় সদস্য হিসেবে মিছিল মিটিং, সভা, সমিতিতে প্রায়ই মধুর ক্যান্টিনে আসতে হতাে। সাম্যবাদে দীক্ষিত হয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদের মহান আদর্শে নিজেকে সম্পৃক্ত করার একটা গৌরব নিয়ে তখন লেখাপড়ার পাশাপাশি, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হই এবং শুরু হয়ে যায় মধুর ক্যান্টিনে আসা যাওয়া। ভাষা আন্দোলন থেকে ষাটের দশকের সেই উত্তাল দিনগুলােসহ সব আন্দোলনের পীঠস্থানটি মর্যাদা ধরে রেখেছে আশির দশকের স্বৈরাচার বিরােধী ছাত্রগণআন্দোলন সফল করার মধ্য দিয়ে।
ফকির আলমগীর: বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী। এমএ, ১৯৭৮, গণযােগাযােগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাবি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের জীবন সদস্য নং: ৩৮৪০। [লেখাটি সৌরভে গৌরবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় খণ্ড থেকে নেয়া]
আরও পড়ুন আপনার মতামত লিখুন