সনাতনী বিতর্কের সাত-সতেরো
সনাতন শব্দটির অর্থ হচ্ছে শাশ্বত, চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় ও বহুকাল ধরে প্রচলিত। বিতর্ক অঙ্গনে মূলত যে ধরনের বিতর্ক কোন রকম কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া একই নিয়মে বহুকাল ধরে চলে আসছে বা প্রচলিত রয়েছে তাকে সনাতনী বিতর্ক বলে। বাংলাদেশে সনাতনী বিতর্কের সর্বশ্রেষ্ঠ আয়োজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় জাতীয় টেলিভিশন বা বিটিভি বিতর্ককে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কলেবরের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে সনাতনী ধারায় বিতর্কের আয়োজন করে আসছে প্রথম আলো - বন্ধুসভা। অর্থাৎ বিটিভি ও প্রথম আলো আয়োজিত বিতর্কের ধরন হয়ে থাকে সনাতনী। সাবেক বিতার্কিক বিরূপাক্ষ পাল সনাতনী ধারার বিতর্ককে 'ওল্ড ইজ গোল্ড' হিসেবে মন্তব্য করেছেন।
মঞ্চ পরিচিতি:
সনাতনী বিতর্কের মঞ্চে তিনটি পক্ষ থাকে। পক্ষ দল, বিপক্ষ দল এবং বিচারকবৃন্দ। নির্ধারিত বিষয়ের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরে পক্ষ দল, আর বিষয়ের বিপক্ষে ও পক্ষ দলের বক্তব্যের বিরোধীতা করে যুক্তি, তথ্য,তত্ত্ব ও উদাহরণ উপস্থাপন করে বিপক্ষ দল। অন্যদিকে উভয় পক্ষের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে মূল্যায়ন ও ফলাফল প্রদান করে বিচারকবৃন্দ। তিন / পাঁচ / সাত সংখ্যক বা বিজোড় সংখ্যক সদস্য নিয়ে বিচারক প্যানেল গঠিত হয়। তাদের বাইরে অথবা তাদের মধ্য থেকে একজন মডারেটর বা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি মঞ্চের কোনো এক পাশে একজন ‘সময় সংরক্ষক’ থাকেন। তিনি সময় গণনা করে ও ঘণ্টা বাজিয়ে বিতার্কিক ও বিচারকবৃন্দকে সহযোগিতা করেন।
এর বাইরেও বিতর্ক অনুষ্ঠানে একটি পক্ষ থাকে! তবে তারা বিতর্কে অংশ নেন না। তাদেরকে আমরা বলি দর্শক। বিতর্কে অংশ না নিলেও তাদের উপস্থিতি একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করতে সহায়তা করে। বিশেষ করে বক্তারা যখন চমৎকার তথ্য, উদাহরণ ও যুক্তি তুলে ধরেন তখন দর্শকদের প্রতিক্রিয়া ও হাততালি বিতর্কের আসরকে জমজমাট করে তোলে, বিতার্কিক অনুপ্রেরণা পান, বিচারকরা বক্তার প্রতি মনোযোগ বাড়িয়ে দেন।
সনাতনী বিতর্কের কাঠামো:
সনাতনী বিতর্কে দুটি পর্ব থাকে। গঠনমূলক ও যুক্তিখন্ডন। গঠনমূলক পর্বে পক্ষ ও বিপক্ষ দল যুক্তি, তত্ত্ব, তথ্য ও উদাহরণ দিয়ে বিষয়ের ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ করে থাকে। এ পর্বে উভয় দল থেকে তিন জন করে মোট ছয়জন বিতার্কিক অংশ নেন। প্রথমে যিনি বক্তব্য রাখেন তাকে বলা হয় ‘প্রথম বক্তা’। এরপরে যিনি বক্তব্য উপস্থাপন করেন তিনি ‘দ্বিতীয় বক্তা’। সবার শেষে কথা বলেন তৃতীয় বক্তা, সনাতনী বিতর্কে তাকে বলা হয় ‘দলনেতা’।
গঠনমূলক পর্ব শেষে বিচারক-দর্শকেরা উপভোগ করেন যুক্তখন্ডন পর্ব। এ পর্বে কেবলমাত্র উভয় দলের দলনেতা বক্তব্য রাখার সুযোগ পান। প্রথমে যুক্তি খন্ডন করতে আসেন পক্ষ দলের দলনেতা এবং তারপরে আসেন বিপক্ষ দলের দলনেতা। এরপরে শুরু হয় বিচারকদের পালা। বিচারকবৃন্দ উভয় পক্ষের বিশ্লেষণ ও যুক্তিখন্ডন শুনে মঞ্চে মূল্যায়ন তুলে ধরেন ও রায় প্রদান করেন।
সনাতনী বিতর্কে যেসব বিষয়ে নম্বর দেয়া হয়:
সনাতনী বিতর্কে বিভিন্ন আয়োজনভেদে নম্বর বণ্টন কম বেশি হয়ে থাকে। তবে সনাতনী বিতর্কের সব আসরেই উপস্থাপনা, ভাষার ব্যবহার ও উচ্চারণ, তত্ত্ব ও তথ্য পরিবেশনা এবং যুক্তির প্রয়োগ ও খন্ডন এসব বিষয়ের উপর নম্বর দেয়া হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশনের আয়োজনের নম্বর বণ্টন নিম্নরূপ-
উপস্থাপনা ০৫
ভাষার ব্যবহার ও উচ্চারণ ০৫
তত্ত্ব ও তথ্য পরিবেশনা ১০
যুক্তির প্রয়োগ ও যুক্তিখন্ডন ০৫
মোট ২৫
সময় ও সম্বোধন:
সাধারণত গঠনমূলক পর্বে প্রত্যেক বক্তাকে ৫ মিনিট করে সময় দেয়া হয়। আর যুক্তি খন্ডন পর্বে দুই দলনেতা ৩ মিনিট করে সময় পান। সাম্প্রতিক সময়ে সেমি-ফাইনাল বা ফাইনাল বাদে অন্যান্য পর্বে আয়োজকরা গঠনমূলক ধাপে ৩ মিনিট ও যুক্তিখন্ডনে ২ মিনিট করে সময় দিয়ে থাকে। সবচেয়ে ভাল হয়, প্রস্তুতির আগেই আয়োজকদের কাছ থেকে সময় সম্পর্কে জেনে নিলে। বিতার্কিকদের জেনে রাখা ভাল, বক্তার নির্ধারিত সময় ফুরাবার এক মিনিট আগে সময় সংরক্ষক সতর্কতামূলক সংকেত দেন। নির্ধারিত সময় শেষে বাজানো হয় চূড়ান্ত সংকেত।
সনাতনী বিতর্কে একটি দল অপরদলকে প্রতিপক্ষ অথবা দলের নামে (পক্ষ দল, বিপক্ষ দল) সম্বোধন করে থাকে। তবে কোনোভাবেই কোন বক্তাকে তার নাম ধরে বা বিতর্কের মঞ্চের বাইরের কোনো সম্পর্কের আলোকে যেমন: ‘প্রতীক ভাই / যুথি আপা, বলেছেন’ - এ জাতীয় সম্বোধন করা যাবে না। ‘প্রতিপক্ষের বা পক্ষ দলের / বিপক্ষে দলের প্রথম বক্তা, দ্বিতীয় বক্তা অথবা দলনেতা বলেছেন’ এভাবে তার দায়িত্ব বা অবস্থানের নামে সম্বোধন করতে হবে।
সনাতনী বিতর্কে অনেকে ‘মাননীয় স্পিকার’ সম্বোধন করেন, যা ভুল। মাননীয় স্পিকার সংসদীয় বিতর্কের পরিভাষা। সনাতনী বিতর্কে এ ক্ষেত্রে ‘মাননীয় সভাপতি’ বা ‘মাননীয় মডারেটর’ সম্বোধন করতে হয়। আর বিচারকদের ‘বিজ্ঞ বিচারকমণ্ডলী/বৃন্দ’ হিসেবে সম্বোধন করতে পারেন। নিজ দলের অথবা প্রতিপক্ষ দলের কাউকে 'তুই, তুমি' সম্বোধন করা শোভনীয় নয়। বিশেষ উদাহরণ বা উদ্ধৃতি ছাড়া বিতর্কের মঞ্চে সবাইকে ‘আপনি’ সম্বোধন করা উত্তম।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, তর্কজাল এবং
সাবেক বিতার্কিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
www.facebook.com/msikhan11