Bangla Runner

ঢাকা , সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | বাংলা

শিরোনাম

দালালি করে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ নেই : শেখ হাসিনা বিতর্ক কী? কেন করবো? বিতর্ক + বিনয় = বড় মানুষ ঢাবি ব্যান্ড সোসাইটি’র এগারো সদস্যের নতুন কমিটি ঢাবি ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি মাসুম, সম্পাদক ফুয়াদ  মুহসীন হল ডিবেটিং ক্লাবের সভাপতি ফুয়াদ, সম্পাদক মেহেদী ফ্রান্সের বিপক্ষে জয় পেয়েও শেষ ষোলোয় উঠতে পারলো না তিউনিশিয়া ডেনমার্ককে হারিয়ে ১৬ বছর পর শেষ ষোলোতে অস্ট্রেলিয়া চট্টগ্রামে নেপাল এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটের জরুরি অবতরণ ডিআরইউ’র সভাপতি নোমানি, সম্পাদক সোহেল
Home / ক্যাম্পাস

বিতর্ক চর্চা

বিতর্ক কী? কেন করবো?

এম.এস.আই খান
রবিবার, ২৯ জানুয়ারী, ২০২৩ Print


‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত না–ও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি জীবন দিতে পারি।’ ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার–এর এই কথাটির আনুষ্ঠানিক চর্চা করে বিতর্ক। তবে বিতর্ক নিয়ে আমাদের দেশের বহু মানুষের চিন্তা এখনো ইতিবাচক নয়। তারা বিতর্ক আর ঝগড়ার পার্থক্য বোঝেন না এবং মনে করেন- যারা বিতর্ক করে তাঁরা সবকিছুতেই তর্ক করার চেষ্টা করে। বিতর্ক বিরোধীরা বিশ্বাস করেন- ‘যুক্তি দিয়ে মুক্তি মেলে না’ কিংবা ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’। কিন্তু এই কথা দুটোতেও গলদ রয়েছে। কখন বিশ্বাসে আস্থা রাখতে হবে আর কখন যুক্তিতে ভর করে এগোতে হবে সেটিও একজন বিতার্কিক তাঁর বিচক্ষণতা দিয়ে বুঝে নিতে পারেন। ‘অন্ধ বিশ্বাস’ এর গলিতে আলো ফেলে সামনে এগোতে পারে বিতার্কিকরা। প্রশ্ন করে সত্য উন্মোচন করার মত সাহসী প্রজন্ম গড়ে তোলে বিতর্ক। যার শুরুটা করেছিলেন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস।

ঝগড়াতে যুক্তি মূখ্য নয়। সেখানে থাকে জোর, বিতর্কে জোরের নয়, যুক্তির জয় হয়। বি-তর্ক মানে বিশেষ তর্ক। এই তর্ক সতর্কতার সাথে করতে হয়। গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস এর বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়, কথা বলতে হয় কাউকে আঘাত না করে, সম্মান বজায় রেখে বিনয় ও বিচক্ষণতার সঙ্গে। ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতে, ‘বিতর্ক হচ্ছে একটি দ্বন্দ্বমূলক শিল্পকলা, যেখানে সুন্দরভাবে বিদ্যা ও বুদ্ধির সংযোগ ঘটে’।

বিরূপাক্ষ পাল তাঁর ‘বিতর্ক ভুবন’ বইয়ে বিতর্ককে উল্লেখ করেছেন একটি ‘উদ্বুব্ধকরণ শিল্প বা আর্ট অব মোটিভেশন’ হিসেবে। তিনি মনে করেন, উদ্বুদ্ধকরণের শর্ত ছাড়া বক্তৃতা অনেকটা পাগলের কূটতর্কে পরিণত হয়। তাই বিতর্ক হচ্ছে- মন জাগানোর মন্ত্র, মন গলানোর কলা। মানুষকে শুভকাজে টেনে আনার সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা ভালো কথার। আর তাই বিতর্ক হচ্ছে ভালোভাবে কথা বলার বিদ্যা।

বিতর্কশাস্ত্রের জনক বিবেচনা করা হয় ডেমস্থেনিস কে। কারণ তিনি যখন বক্তৃতা করতেন তখন মানুষ এতটাই উদ্বুদ্ধ হত যে, তাঁরা বলত- ‘চলো এখনই এগিয়ে যাই’। অর্থাৎ ডেমস্থেনিস যে দিকে আহ্বান করতেন লোকে সেদিকে ভীষণমাত্রায় উদ্বুদ্ধ হত। তাই বলা যায়, নিজের চিন্তাকে প্রকাশ ও মানুষের কাছে সেটিকে গ্রহণযোগ্য মাত্রা দিতে বক্তৃতা বা বিতর্ক অত্যন্ত চমৎকার একটি মাধ্যম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে নির্বাচনী বিতর্ক তারই নজির। মার্কিন মুলুকে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ বক্তৃতা, মার্টিন লুথার কিং -এর ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ কিংবা আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মাঝে এক অসম্ভব সম্মোহনী শক্তি নিহীত রয়েছে। বিশ্বের লক্ষ-কোটি জনতা আজো উদ্বুদ্ধ হয় এই বক্তৃতাগুলো শুনলে। একজন বিতার্কিক চর্চার মাধ্যমে এই যাদুকরি গুণটি রপ্ত করতে পারে, নিজেকে জগৎ বিখ্যাত করে তুলতে পারে তাঁর পছন্দের কর্মক্ষেত্রে।

বিতর্কের সবচেয়ে বড় গুণ এটি নিজেকে প্রকাশ করতে শেখায়। চাণক্যের একটি কথা রয়েছে- ‘গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়ােজন’। অর্থাৎ সময়মত উপযুক্ত জ্ঞান বা তথ্য যদি প্রকাশ করা না যায় তবে সে জ্ঞান কোন উপকারে আসে না। বিতর্ক চর্চা একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও সুপ্ত প্রতিভাকে প্রকাশ করে। মুখস্ত বিদ্যার বাইরে এনে প্রতুৎপন্নমতি করে তোলে। বিতর্ক চর্চা নানান বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে শিক্ষার্থীকে ভাবতে ও বিশ্লেষণ করতে শেখায়। ধরা যাক, বল্যবিবাহ নিয়ে একজন শিক্ষার্থী তাঁর পাঠ্য বইয়ে পড়েছে। ঠিক এ বিষয়েই যদি ওই শিক্ষার্থীকে বিতর্ক করতে দেয়া হয় যে, ‘আইনের প্রয়োগই পারে বাল্যবিবাহ ঠেকাতে’। এই শিক্ষার্থী তখন তাঁর পুথিগত বিদ্যা, তাঁর সমাজ বাস্তবতা ও নিজস্ব চিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে বিষয়টির পক্ষে বা বিপক্ষে বক্তব্য তুলে ধরবে। এর মধ্য দিয়ে জীবনের যে স্তরেই বাল্যবিবাহ নিয়ে লিখতে বসুক না কেন, সে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাসে আমার শিক্ষক অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলম বলেছিলেন, যদি তুমি কোন বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পার এবং সেই চিন্তাকে সুন্দরভাবে লিখতে ও বলতে পার তাহলে জীবনে যে ক্ষেত্রেই তুমি যাও না কেন, তুমি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছেন- If you can't explain it simply, you don't understand it well enough. অর্থাৎ সহজভাবে কোন কিছু তুলে ধরার জন্যে গভীরভাবে জানতে হয়। তাই একজন বিতার্কিককে তাঁর অবস্থানের পক্ষের যুক্তি ও তথ্য সংগ্রহ করার জন্য বই-পত্রিকা পড়তে হয়। সেগুলোকে নিজের ভাষায় লিখতে হয়, নিজের চিন্তা, বিশ্লেষণ সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে হয় এবং প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করার জন্য তাঁদের কথাগুলো মনোযোগসহকারে শুনতে হয়। ফলে ভাল বক্তা হওয়ার জন্য ভালো পাঠক ও শ্রোতা হওয়ারও প্রয়োজন পড়ে।

অন্যের মতকে সহ্য করার মানসিকতা- যাকে আমরা বলি পরমতসহিষ্ণুতা- এবং সময়ানুবর্তিতা শেখায় বিতর্ক। অনেক সময়ই দেখা যায় বিভিন্ন সভা-সমাবেশ বা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বক্তা ১০ মিনিটের বক্তৃতায় ৫-৬ মিনিট কাটিয়ে দেন কে কে উপস্থিত আছেন তাদের নাম ও বিশেষণ বলতে গিয়ে। আবার ‘আমি খুব ভাল বক্তা নাই’ এমন কথা বলে বক্তব্য শুরু করা মানুষটির সমস্যা এটি নয় যে, তিনি ভাল বক্তা নন। তার বড় সমস্যা এটি যে, ভাল বক্তা না হয়েও তিনি অধিক সময় ধরে বক্তব্য দিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকদের বিরক্তিভাব বৃদ্ধি করেন। বিতর্ক চর্চার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত স্বল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে দর্শকদের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব কথা বলে দেয়া যায় সেই কৌশল রপ্ত করতে পারেন।

বিতর্ক একজন অন্তর্মুখী শিক্ষার্থীকে বহির্মুখী (Introvert to Extrovert)) করে তোলে। বিতর্ক করতে গিয়ে নানা স্থানে নানা মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, আলাপ হয়। এর মধ্য দিয়ে সম্পর্ক ও পরিচিতি গড়ে ওঠে। এভাবে তৈরি হওয়া যোগাযোগ দক্ষতা পরবর্তী জীবনের নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগে। তাই বিতর্ক একটি শিল্প, একটি আন্দোলন। বিতর্কের মধ্য দিয়ে একজন মানুষ শৈল্পিকভাবে তার মনের ভাব যেমন প্রকাশ করতে পারে, তেমনি সামাজিক নানা অসংগতির বিরুদ্ধে যৌক্তিকভাবে নিজের মত প্রকাশের আন্দোলনে যুক্ত হতে পারে, নেতৃত্ব দিতে পারে।

শেষ কথায় বলব, যদি তোমার মধ্যে বক্তব্য শেখার তুমুল আগ্রহ থাকে তবে একটি কথা ভুলবে না, তা হচ্ছে ‘পরাজয়ে ডরে না বীর’। মনে রাখবে, ‘শিখছো কোথায় ঠেকছি যেথায়’। তাই নিজেকে বরেণ্য বক্তা হিসেবে গড়তে চাইলে অনুশীলনের বিকল্প নেই। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে 'Practice Makes a man perfect' বা ‘গাইতে গাইতে গায়েন’। আমার স্কুল জীবনের ধর্ম শিক্ষক মাহবুবুর রহমানের কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলতেন- ‘বলতে বলতে বক্তা, না বলতে বলতে তক্তা’! অর্থাৎ যিনি বলতে ভয় পান এবং এই ভয়কে জয় করার চেষ্টা করেন না, ধীরে ধীরে তিনি শুকনো কাঠের মত হয়ে যান। ফলে বলতে বলতেই আমাদের বক্তা হতে হবে।

লেখক: বিতর্ক ও অনুষ্ঠান সম্পাদক, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ এবং সহ-সভাপতি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি।
www.facebook.com/msikhan11

আরও পড়ুন আপনার মতামত লিখুন

© Copyright -Bangla Runner 2021 | All Right Reserved |

Design & Developed By Web Master Shawon