শুভ জন্মদিন প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জন্মদিনের শুভেচ্ছা নাও প্রাণের প্রাঙ্গন, জন্মদিনের শুভেচ্ছা নিও আমতলা, বটতলা, মল চত্ত্বর আর কার্জন পুকুর পাড়। জন্মদিনের শুভেচ্ছা নিও আমার প্রিয় শিক্ষার্থীরা। আমাদের এই প্রাণের প্রাঙ্গনের বাঁকে বাঁকে ইতিহাস কথা কয়। এই প্রাঙ্গনের আকাশে বাতাসে এখনও অনুরণিত হয় পৃথিবীর মধুরতম শব্দমালা- ‘‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ছাইচাপা আগুন যে প্রাঙ্গণের মধ্যাকর্ষণশক্তিতে তাকে জানাই আজ লাল সালাম।
যাদের কলকাকলিতে রোজ ভোর আসে এখানে, প্রিয় শিক্ষার্থীরা, তারা আজ ভালবাসা নাও। তোমাদের ছাড়া মৃত এই শত বছরের লালরঙ্গা অবকাঠামো । তোমাদের অগ্রজদের মতই এই প্রাঙ্গণের স্পন্দন তোমরা। জন্মদিনে ইটের সুরকির ভাজে ভাজে তোমাদের অগ্রজদের আজ কত ফিসফাস। কত কথা, কত ব্যথা, কত স্বপ্ন ভাঙ্গাগড়ার স্মৃতিকথা এ মায়াভরা ছায়াপথে কে রাখে সে খবর...।তবে জন্মদিনের সোনালী রোদ্দুরে আজ কোন স্বপ্ন ভঙ্গের গান গাইতে চাই না। যেন ১০০তম জন্মদিনে কেবল স্বপ্নের কথা লিখতে পারি সেই কামনা করেই আজকের এই লেখা।
১ জুলাই ২০১৯, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে আজ সারাদিন অনেক সভা হবে, কথা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীগণ সকলে একসাথে জমায়েত হবেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও হলসমূহের পতাকার পাশে সগর্বে উড়বে প্রাণের লাল সবুজের জাতীয় পতাকা। “গুণগত শিক্ষা, প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণ” শ্লোগান নিয়ে অনেক ভারি ভারি বক্তব্য দেবেন গুণীজনেরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং, ছাত্র/শিক্ষক রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা-অপ্রাসঙ্গিকতা, শিক্ষার মান, গবেষণার সুযোগ, বাজেটের অপ্রতুলতা, কতিপয় শিক্ষকের বিমাতাসুলভ আচরণ, কতিপয় শিক্ষার্থীর অছাত্রসুলভ আচরণ এসকল কিছুর সূত্রধরে শিক্ষার্থীদের কিংবা শিক্ষকদের দায়-দায়িত্ব নিয়ে পরস্পর দায় এড়ানোর প্রতিযোগিতা হবে আজও। আরও বাড়বে দুইপক্ষের ব্যবধান।
আর গত কয়েক বছর ধরে, এই ভয়ই আমাকে প্রেতাত্মার মত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এভাবেই এক এক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়সের সাথে সাথে বাড়তে থাকবে এই প্রাঙ্গনের হাজার বছরের রাত। সে রাত যদি পোহাতে হয়, তাহলে আজই আমাদের ভাবতে হবে ভিন্ন আয়োজনে। এ আয়োজনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতি সভার দরকার হবে না, দরকার হবে না আলাদা বাজেটেরও। প্রয়োজন নেই কোন মিলনায়তন ও সাউন্ড সিস্টেমের। শুধু যা প্রয়োজন তা হল, একটু সময়। চল, চলুন সবাই এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে মুক্তি দেই আজ। যেখানে আছি ঠিক সেখানের সবুজ ঘাসেই একটু বসি। কান পাতি এই প্রাণের প্রাঙ্গণের আকাশে-বাতাসে-মাটিতে। কী শুনতে পাই...?
আমি শুনি, কেবলই আর্তচিৎকার... যে যার যার মতন করে নিজেদের নিয়ে ভেবে প্রতিদিন ক্ষতবিক্ষত করে চলেছি এই প্রাঙ্গন। ‘যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি দেশের জন্ম দিয়েছে, সেই দেশের মানুষ অনেক বেশি কিছু চায় আমাদের কাছে, তোমাদের কাছে, আপনাদের কাছে’- এই বাক্য কেবল পুঁথিগত বাক্য হয়ে পরছে দিনদিন। আজকের জন্মদিনের পূর্ব-নির্ধারিত কর্মসূচীতে যে আলোচনা আজ অন্তর্ভুক্ত নেই চলুন আজ সেই আলোচনা করি।
চলুন, প্রশ্ন করি নিজেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা বঞ্চিত করছি না তো? আমরা যার যার অবস্থানে থেকে আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছি কি? এই দায়িত্ব মানে শিক্ষাদানের দায়িত্ব, শিক্ষাগ্রহনের দায়িত্ব, শিক্ষাদানের পরিবেশ বজায় রাখার দায়িত্ব, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা আবাসনের সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এই আমরা মানে আমি, আপনি, তুমি, শিক্ষকেরা, শিক্ষার্থীরা, শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা, আমাদের অগ্রজরা সবাই। নানান উপলক্ষ আর আয়োজনের ভিড়ে আমাদের সেভাবে ভাবার সময় হয় না আজকাল। আমরা কেবল পরস্পর দায় এড়াতে ব্যস্ত।
সারা বাংলাদেশের হাজার জোড়া চোখের স্বপ্ন গড়ার কারিগর আমরা, ভাঙ্গার নয়। বাংলা ভাষার অভিধানের আমার সবচেয়ে অপছন্দের একটি শব্দ হল, কতিপয়। এই কতিপয় শিক্ষকের দায়হীনতা, কতিপয় শিক্ষার্থীর অছাত্রসুলভ আচরণ, দেশের কতিপয় জাতিয় রাজনীতিবিদের অসাধু উদ্দেশ্য দিন দিন ধ্বংস্সতুপে পরিণত করছে এই প্রাণের প্রাঙ্গণকে। আমরা চাই, শিক্ষা আর গবেষণার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে ওঠা শত বছরের শিক্ষাঙ্গন তাঁর জ্ঞানের আলো ছড়াবার মূল দায়িত্ব থেকে সরে না আসুক।
আর সেই পথে এগুতে হলে সবচেয়ে বেশি দরকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পরস্পরের সহমর্মী শিক্ষাবান্ধব আচরণ, শিক্ষাঙ্গনবান্ধব পরিবেশ। শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের কিংবা শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের পরস্পরের বাক্যবাণ ধারালো না হয়ে মসৃণ হোক, মধুর হোক, সম্মানের হোক। ঘুচে যাক ডায়াসের উভয় পাশের মানুষগুলোর ব্যবধান। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রম তালিকায় স্থান পাবার চেয়ে বেশি দরকার মানবিক মূল্যবোধের লালনকারি শিক্ষাবান্ধব শিক্ষাঙ্গনের। এই বিষয়টি মননে ধারণ করে শিক্ষক শিক্ষার্থী প্রশাসন সকলে নিজেদের দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একদিন আর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে পরিচয় দেবার প্রয়োজন পরবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বনামেই সারা বিশ্বে তাঁর জ্ঞানের দ্যুতি ছড়াতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
লেখক: সহকারি অধ্যাপক, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এ সম্পর্কিত আরো:
০১. ঢাবির প্রথম উপাচার্য হার্টগ বুঝেছিলেন বাঙালি সমাজে তদবির কী জিনিস!
০২. অন্ন জোটেনি,পায়ে জুতা ছিল না সেই ছেলে হয়েছিলেন ঢাবির উপাচার্য
০৩. গৌরবের পথ চলায় ৯৯ বছরে পা দিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
০৪. ঢাবি ভিসি আখতারুজ্জামান: একজন ফুলব্রাইট স্কলারের গল্প
আরও পড়ুন আপনার মতামত লিখুন