বঙ্গবন্ধু প্রথমবার জেল খাটেন ১৯৩৮ সালে তাঁর সহপাঠী আবদুল মালেককে উদ্ধার করে আনার দুঃসাহস দেখানোর জন্য। হিন্দু মহাসভা সভাপতি সুরেন ব্যানার্জির বাড়িতে নিয়ে মালেককে অকথ্য অত্যাচার করা হয়। বঙ্গবন্ধু এই অত্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, ‘ওকে ছেড়ে দিতে হবে, নাহলে কেড়ে নেব।’১ লুটপাট, দাঙ্গা - হাঙ্গামার মিথ্যা অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে জেল খাটতে হয়। মহকুমা প্রশাসক হিন্দু হওয়ায় জামিন পাননি তিনি।
পরবর্তী সময়ে তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন উপযুক্ত প্রতিশোধ নেয়ার। ১৯৪৬ সালে দাঙ্গার সময়মত চাইলে হিন্দুদের উপর কোপপরায়ণ হতে পারতেন। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক মুজিব মুসলিম লীগ কর্মী হয়েও হিন্দুদের রক্ষার জন্য কাজ করেন। স্বনামধন্য ভারতীয় অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত লিখেছেন: “এখানে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি ইসলামিয়া কলেজের সেইসব মুসলমান ছাত্রদের যাঁরা আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে বিপদজনক এলাকাটা পার করে দিতেন। এইসব ছাত্রের একজনের নাম ছিল শেখ মুজিবুর রহমান।”২
বঙ্গবন্ধু সর্বাবস্থায়ই নিজস্ব নীতিতে অটুট থাকতেন। পথ প্রতিকূল হলেও সে পথে পা বাড়াতে দ্বিধা করতেন না। সেজন্য চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে শামিল হয়ে হারিয়েছিলেন ছাত্রত্ব, তথাপি মুচলেকা দেননি।
বঙ্গবন্ধু ১৯৫৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য, শিল্প, শ্রম ও দুর্নীতিদমন বিভাগের মন্ত্রী হন। তিনি পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। উল্লেখ্য ১৯৫৪ সালে আমলাদের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে এনে জনগণের কল্যাণের চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ফল হয়েছিল উলটো। আমলাদের ষড়যন্ত্রে নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুটমিলে বাঙালি - অবাঙালি বিরোধ লাগে এবং সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ এনে, এরাই যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করার ব্যবস্থা করে।
এরূপ অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু আমলাদের অযথা ফাইল আটকানো বন্ধের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন এবং একবার এক সিনিয়র অফিসারকে ডেকে বলেন, ‘শুনতে পাই আপনার কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা, কিন্তু আপনার যা চালচলন দেখতে পাচ্ছি, তাতে তো আমার মনে হয় যে, আসলে আপনার অভিজ্ঞতা এক বছরের, সেটাকে আপনি কুড়ি বছর ধরে টেনে চলেছেন।’৩ প্রখর ন্যায়নিষ্ঠা না থাকলে বঙ্গবন্ধু এমন মন্তব্য করতে পারতেন না।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন কায়েম করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার আদলে শুরু করে শোষণ। ফলে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে প্রতিটি বাঙালির মুক্তির অঙ্গীকার ‘ছয় দফা’ ঘোষণা করেন। এতে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থকে উত্থাপন করা হয়। এর ফলে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী উল্লেখ করে তাঁর নামে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনেন।
তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, ‘মুজিব যদি যুক্তির ভাষা না বোঝেন, তাহলে তাঁকে অস্ত্রের ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হবে।’৪ এর পরপরই বঙ্গবন্ধুর নামে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করা হয়। কিন্তু সামরিক জান্তার হুমকিতে টলার মতো ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু নন। ১৯৬৬ - ১৯৬৯ সালে কারাগারে রাজবন্দি থাকার সময়ও তিনি লিখেছেন, ‘‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক পথেই মোকাবিলা করা উচিত। যে পথ তারা অবলম্বন করেছে তাতে ফলাফল খুব শুভ হবে বলে মনে হয় না।... এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার সংগ্রাম।’’৫
বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল জনগণের ক্ষমতায়ন। তাঁর আপোষহীন মনোভাবের জন্যই সামরিক শাসকরা শূন্যের ওপর ক্ষমতার প্রাসাদ নির্মাণ করতে ব্যর্থ হয়। দাবি না মানলে কোনো আলোচনা নয় জানিয়ে ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি বলেন, ‘ঐ শহীদদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আর.টি.সি.তে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না ‘ সেদিন রেসকোর্সের মাঠ এবং শহরের সব জায়গায় হেলিকপ্টার গানশিপ ও সশস্ত্র আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছিল পাকিস্তানিরা।৬ কিন্তু তবুও তাঁর কণ্ঠে ঘোষিত হয় ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশ।’৭ তিনি বলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ নীতির প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু আজীবন ছিলেন অবিচল এবং কখনোই কোনো উদ্যত খড়গের সাথেও তিনি আপোষ করেননি।
সুহৃদ সাদিক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র:
১. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ইউ.পি.এল., ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ১২
২. ভবতোষ দত্ত, আট দশক, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃ. ১১৭
৩. মুনতাসীর মামুন (সম্পাদিত), বঙ্গবন্ধু কোষ, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ঢাকা, ২০১২, পৃ. ১৬৮
৪. অনুপম সেন, বাংলাদেশ : ভাবাদর্শগত ভিত্তি ও মুক্তির স্বপ্ন, অবসর, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ৫৩
৫. শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৭, পৃ. ৬৫
৬. শামসুজ্জামান খান, বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ : একটি গোলটেবিল আলোচনা, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৯, পৃ. ১৮
৭. সনৎকুমার সাহা, বঙ্গবন্ধু - বাংলাদেশ, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০২০, পৃ. ৯৩