২৮ ডিসেম্বর: জন্মবার্ষিকী
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এবং গৌরবমণ্ডিত বিদ্যাপীঠের নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এটি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঔপনিবেশিক শাসনামলে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তী সময়ে নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষা - কার্যক্রম, বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ এবং গণতন্ত্র বিনির্মাণে রেখেছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। সুতরাং এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নয় যে, কেবলমাত্র বঙ্গভঙ্গ রদের ' জাঁকজমকপূর্ণ ক্ষতিপূরণ (The University of Dacca as a splendid compensation) ১ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মূলত সমকালীন পূর্ববঙ্গে শিক্ষার অবস্থা ও সুযোগ, এখানকার মুসলমান নেতৃবৃন্দের দাবির প্রতি তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসকদের সহানুভূতিশীল মনোভাব ইত্যাদি পরিস্থিতি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি। অবশ্য এটি প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে বৃটিশ সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না এমন নয়। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের স্বাধীন সত্তার বিকাশ ঘটতে দিলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে তা হিতকর হবে বলে বৃটিশ সরকার মনে করেছিল।
কিন্তু তাদের আশা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। ধীরে ধীরে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার বিকাশ ঘটে। আর এটিই ক্রমান্বয়ে পরিণত হয় ব্রিটিশ বিরোধিতায়। এ প্রসঙ্গে গবেষক আবদুর রহিম লিখেছেন, "কিন্তু কি চমৎকার ক্ষতিপূরণ যে, ১৯১২ সালে যার প্রস্তাব হলো,১৯২১ সালেই মাত্র তার বাস্তবায়নের শুরু হল। অথচ এর মধ্যে অর্থাৎ এই দশ বছরে কেবল বঙ্গভঙ্গ রদ হয়নি, ১৯১৪ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত প্রথম মহাযুদ্ধটা সংঘটিত হয়েছে, ১৯১৬ তে হিন্দু - মুসলমান নেতৃবৃন্দ সমঝোতার প্রয়োজন উপলব্ধি করে লক্ষ্মৌ চুক্তি সই করতে সক্ষম হয়েছে এবং বড় কথা ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পরে দেশব্যাপী হিন্দু - মুসলমান ঐক্যবদ্ধ অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা ঘটেছে,যে আন্দোলনে মৌলানা শওকত আলী এবং মৌলানা মোহাম্মদ আলীর ন্যায় মুসলিম নেতা যোগ দিয়েছেন। এ সমস্ত ঘটনাদৃষ্টেই ইংরেজ প্রতিভূগণ বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছে ১৯২২ সালে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে 'একটি চমৎকার রাজকীয় ক্ষতিপূরণ হিসেবে চিন্তা করা হয়েছিল '।ইংরেজ প্রতিভূগণ এসব ঘটনাতে অধিকতর সচেতনতার সঙ্গে বুঝল যে, নবজাগ্রত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এখন যত না দান করা দরকার আধুনিক বিজ্ঞানের জ্ঞান, তার চেয়ে অধিক ইসলামী ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বোধ। আর তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কোর্টের মিটিং এ ইংরেজ ভাইস চ্যান্সেলর হার্টগ বললেন, 'ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অধ্যয়নই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে '। এজন্য আরবি এবং ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে যাকে প্রধান হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করা হয় তিনি একজন ইউরোপীয়। "২
এখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে কেবল মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এই ভুল করার সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য সেই সময় কেউ কেউ একে মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়ও বলেছিলেন। ভবতোষ দত্ত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বরাত দিয়ে লিখেছেন, "শোনা যেত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নাকি বলেছিলেন - 'এসেছিলাম ডাক্কা (ঢাকা) ইউনিভার্সিটিতে, এসে দেখি মক্কা ইউনিভার্সিটি, কিছুদিন পরে দেখলাম ফক্কা ইউনিভার্সিটি, এখন দেখছি ধাক্কা ইউনিভার্সিটি। "৩
কিন্তু এ ধরনের মন্তব্য আদতে গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯১২ সালে নাথান কমিশনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার শক্ত অবস্থান নেয়। ১৯২১ সালের ১ জুলাই আইনানুগভাবে ও আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয় এই প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু এরও অনেক আগেই ১৯২১ সালের ৭ জানুয়ারি নরেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরীর বাসভবনে ঢাকা সাহিত্য সমাজের উদ্যোগে আয়োজিত এক সান্ধ্য সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ফিলিপ হার্টগ এই প্রতিষ্ঠানকে সকলের জন্য উন্মুক্ত হিসেবে ঘোষণা করেন।৪ সুতরাং এ বিষয়ে অতিরিক্ত উৎসাহ দেখানো সমীচীন নয়।
এদেশে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার ক্ষেত্রে স্যার ফিলিপ হার্টগের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন দক্ষ প্রশাসক। তবে তিনি 'কসমোপলিটন শিক্ষা'৫ পেয়েছিলেন ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিতে। তিনি লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ স্কুল, তারপর দ্য ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস, জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সবশেষে কলেজ দ্য ফ্রান্সে শিক্ষাগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য এই কলেজ দ্য ফ্রান্সের ছাত্র ও শিক্ষক ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক মিশেল ফুঁকো। ব্যক্তিগত সুখ - শান্তি বিসর্জন দিয়ে হার্টগ, উপনিবেশিত দেশে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল স্থাপনে প্রয়াসী হন। তিনি কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও ঢাকাকে অগ্রসর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। স্মর্তব্য যে, ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন পুনর্গঠনেও তাঁর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে, এমনকি তিনি বিশ্ববিখ্যাত ' The School of Oriental and African Studies '(SOAS) এও দায়িত্ব পালন করেছেন। 'তাঁর পাঁঁচ বছরের প্রশাসনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ভারতবর্ষের নয়, কমনওয়েলথ দেশগুলোর মধ্যে একটি মানসম্পন্ন বিদ্যাপীঠের স্বীকৃতি পায়। '৬
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম উপাচার্য আহমদ ফজলুর রহমান (পরবর্তীতে স্যার এ.এফ. রহমান)। তিনি ১৮৮৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর জলপাইগুড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট রহমান ১৯২১ সাল পর্যন্ত আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কাজ করেছেন। '১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ যাত্রা শুরুর সময় ৫ জন শিক্ষক ও ১ জন সহকারী পাঠদানের জন্য নিযুক্ত হন। রমেশচন্দ্র মজুমদার অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে, আহমদ ফজলুর রহমান রিডার হিসেবে এবং পরেশচন্দ্র মুখার্জী, শৈলেশ চন্দ্র ব্যানার্জী ও সুধীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য প্রভাষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, আর নীলমণি সরকার হন সহায়ক। '৭ তবে উল্লেখ্য যে, আহমদ ফজলুর রহমানের নিয়োগ ছিল স্বতন্ত্র। যোগ্যতার সাথে সুপারিশের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এ যুগে যোগ্যতা ছাড়াই তদবিরের জোরেই অনেক কর্ম সম্পাদিত হতে দেখা যায়। তবে সে যুগে কেবল যথার্থ গুণী ব্যক্তিকে সুপারিশ করাই চল ছিল। ১৯২০ সালের ৬ মার্চ ঢাকার নবাবের নিকট লিখিত এক পত্রে এ.এফ. রহমান লেখেন,
"I am writing this letter to beg a favour from you and to remind you of your very kind promise to me. The Dacca University Bill will become an Act by the end of this month and it is almost certain that some initial appointments will be made almost immediately. It is remoured here that Mr. De Fosse, the Director of Public Instruction of these Provinces is going to be the first Vice - Chancellor of this University. He is known to have no sympathy with the Mohammedans ; the other appointments will be made by the Governor's of Bengal in consultation with the Vice - Chancellor, the Director of the Public Instruction, Bengal and such other gentleman that the Governor desires to consult. I feel sure that if you spoke to the Governor about me, I may get a good position in the Dacca University. They are going to start a Muslim Hall in the University, if you care to recommend me for the headship of that with a Professorship in the University. "৮
নবাব সাহেবের সুপারিশ কাজে এসেছিল। বাংলার গভর্নর জেনারেল তাঁকে বিফল মনোরথ করেননি। ফলে এ.এফ. রহমান ইতিহাস বিভাগের রিডার ও মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান।
১৯২৩ সালে স্যার রহমান বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হন। এজন্য ওখানে তাঁকে প্রচুর সময় দিতে হয়েছে যার দরুন ১৯২৮ সাল পর্যন্ত তাঁকে অসংখ্যবার ছুটি নিতে হয়েছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এভাবে তাঁকে বার বার ছুটি দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। এতে ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে তিনি ইতিহাস বিভাগের রীডার পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যকরী পরিষদ (Executive Council) তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে। কিন্তু স্যার রহমানের ভূমিকা ও অবদান সম্পর্কে অবগত ছিলেন তারা এবং তার যথার্থ মূল্যায়নও করেছেন। ১৯৩৪ সালে উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। ১৯৩৪ সালের ১ জুলাই তিনি দায়িত্বগ্রহণ করেন এবং ১৯৩৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই পদে কর্মরত থাকেন। ১৯৩৭ সালে ভারতীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন তিনি ; আর সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক 'ডক্টর অব ল' প্রদান করে। ১৯৪৫ সালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
স্যার এ.এফ. রহমানের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা সম্পর্কে জানতে হলে, জর্জ হ্যারি ল্যাংলির (১৮৮১ - ১৯৫১) সময়কালের নাতিদীর্ঘ আলোচনা আবশ্যক। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগদান করেন। ১৯২১ - ১৯২৫ পর্যন্ত তিনি ঢাকা হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯২৫ সালেই ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন এবং ১৯২৬ সালের জানুয়ারি মাসেই উপাচার্য হন। মূলত এরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সমস্যা ও জটিলতা তৈরি হতে থাকে।৯ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকেই ঢাকাতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর নিয়মিত অবস্থান ছিল। তবে ব্রিটিশ সরকার লক্ষ করেছিল যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র - শিক্ষকরা সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনার স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন নন ; তাই বিভিন্ন উপলক্ষেই শহরে সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯২৬ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয় মেজর কারবেরিকে।১০ সেখানে অত্যন্ত তুচ্ছ বিষয়ে ছাত্র ও সৈনিকদের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুধাবন করে মেজর কারবেরি ঘটনার জন্য দায়ী কর্পোরাল রেই ও প্রাইভেট লুকাসকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেন।১১ বিষয়টি তখনই মিটে যেতে পারত। কিন্তু ছাত্ররা উপাচার্য ল্যাংলির কাছে ঘটনা জানিয়ে বিচার দাবি করে। ছাত্রদের আচরণ অশোভন মনে হয়েছিল মি. ল্যাংলির কাছে। ফলে পরবর্তী সময়ে এই আত্মাভিমানের জন্য ছাত্রদের সাথে তাঁর সম্পর্ক আর স্বাভাবিক হয়নি। তিনি ১৮ ফেব্রুয়ারি সেদিনের ঘটনার বাঙালি কুশীলব অরুণ কুমার মুখার্জীকে মেজর কারবেরির কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাব করেন একাডেমিক কমিটির সভায়। এতে করে চরমভাবে উপেক্ষিত হয় ছাত্রদের সম্মান আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা। এটি অবশ্য আর বেশিদূর গড়ায়নি।
কিন্তু ১৯৩০ - এর দিকে ঢাকায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসমূহ, সে বছরই মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল, আইন অমান্য আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা, মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে লোম্যান হত্যা, সুনীতি চৌধুরী কর্তৃক কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা প্রভৃতি ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে 'অনুশীলন ','যুগান্তর ',ও 'শ্রীসংঘ' ইত্যাদি বিপ্লবী সংগঠনগুলোর জোর তৎপরতা চলে।১২ উপাচার্য ল্যাংলি এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হন। ইংরেজ সৈন্যদের চরম উশৃঙ্খলতায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র - ছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মচারীরা চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটান। ১৯৩৪ সালের ২১শে মার্চ সেনাবাহিনীর অশোভন আচরণের শিকার হন শিক্ষক পরিমল রায়।১৩ ১৯৩৪ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা হল এলাকায় এলোপাতাড়ি গুলির ঘটনা ঘটে। এমতাবস্থায় অবসরে যান জর্জ হ্যারি ল্যাংলি এবং দায়িত্ব নেন আহমদ ফজলুর রহমান।
১৯৩৪ সালে দায়িত্ব নিয়েই এসব অশোভন এবং অন্যায় কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানান আহমদ ফজলুর রহমান। মি. ল্যাংলি কিছুটা সংকীর্ণমনা ও হীনমন্য ব্যক্তি ছিলেন ; পক্ষান্তরে বাঙালি ফজলুর রহমান ছিলেন অনেক বেশি দৃঢ়চেতা ও সোচ্চার। 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ও ঐতিহ্য সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অবিতর্কিত ব্যক্তিত্ব এবং শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, সহকর্মী শিক্ষক - কর্মচারী ও ছাত্র - ছাত্রীদের কাছে ছিলেন অতিকাঙ্খিত পুরুষ। '১৪ মি. রহমানের তৎপরতায় ইংরেজ অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এ.এইচ.শ্নেলিং আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করতে বাধ্য হন। এমনকি ঢাকা হল ও সন্নিহিত ছাত্রীনিবাস এলাকায় সৈন্যদের চলাচল নিষিদ্ধ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক পি.বি. জুন্নারকরের বাসভবনের পাঁচিল টপকে প্রায়ই ব্রিটিশ সৈন্যরা প্রবেশ করত। তারা জুন্নারকরের বাসস্থান সংলগ্ন মাঠে ক্রিকেট খেলত। ফলে বল আনার জন্যই সৈন্যরা প্রবেশ করত। ১৫ বাধ্য হয়ে জুন্নারকর উপাচার্য মি. রহমানকে বিষয়টি জানান। উপাচার্য তখন এটি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্য এই মাঠ পরিবর্তন করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে মি. রহমানের দৃঢ়তার কাছে হার মানতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। তারা অচিরেই তাদের ক্রীড়াস্থল পরিবর্তন করে। সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের নিরাপত্তার দিকটি যথেষ্ট চিন্তা - উদ্রেককারী বিষয় ছিল। মি. রহমান তাই ছাত্রীনিবাস সুরক্ষিত রাখার জন্য পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করেন। তবে ১৯ ডিসেম্বর রাতে ছাত্রীনিবাসে কারা যেন কয়েকবার টর্চের আলো ফেলে। এতে ছাত্রীরা সন্ত্রস্ত হয়। উপাচার্য ঘটনা শুনেই পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্টকে নিরাপত্তা জোরদার করতে বলেন। তিনি পত্রে লেখেন, "It has been brought to myy notice that in the evenings, torch lights are flushed on the Women Student's Residence, Bungalow No.7,in the University area. This has agitated both the Lady Superintendent and the girl boarders of the house... I shall be very greatly obliged if you would kindly see your way to offer some protection to the Residence in question. "১৬
অবশ্য পরে জানা যায় টহলের জন্যই টর্চের আলো ফেলা হয়েছিল। সেটা দুরভিসন্ধিমূলক ছিল না। তবে উপাচার্যের এই কর্মকাণ্ড সবাইকে সন্তুষ্ট করে এবং আশার আলো দেখায়। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে এভাবে বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এখানে বহুসংখ্যক গুণী ও বিদ্বান ব্যক্তিদের সহযোগে ১৯২৬ সালে গঠিত হয় 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ'। অবশ্য ১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল 'ঢাকা সাহিত্য পরিষদ'। সেটি ছিল মূলত ঢাকার মধ্যবিত্ত হিন্দু - সম্প্রদায়ের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র। তাই 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ'কে অনেকে প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন বলে মনে করেন। কিন্তু তা ঠিক নয়। কারণ এটি ছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠন, যেখানে হিন্দু - মুসলমান মিলিতভাবে সাহিত্য ও সংস্কৃতি আলোচনায় ব্যাপৃত হয়। ১৭ ফজলুর রহমানও পরোক্ষভাবে এর সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যমনা ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি। সাহিত্য ও ইতিহাসের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ স্বীকার করতেন না তিনি। ১৯২৭ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের অনুষ্ঠানে অভ্যর্থনা সমিতির পদ অলংকৃত করেন স্যার রহমান। সভাপতি হিসেবে দেয়া তাঁর অভিভাষণটি ছিল ঐতিহাসিক ও সমকালীন রাজনৈতিক চেতনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, "সাহিত্য জীবনী শক্তির পরিচায়ক। বলবার মত কথা থাকলে ভাষার অভাব হয় না। আর বলবার মত কথা না থাকলেই সাহিত্যেরও সৃষ্টি হয় না। পৃথিবীর ইতিহাস পাঠ করে পরীক্ষাতে পাশ করাই জীবনের উদ্দেশ্য নয়। ইতিহাস জ্ঞানের আকর। কিন্তু সেই জ্ঞান শুধু নিজের উপলব্ধি করা জ্ঞানীর কাজ নয়। জ্ঞান বা সত্য প্রচার করা; সমাজ, দেশ, পৃথিবী সত্যের আদর্শে গড়ে তোলা ; সেই হলো মানুষের মত কাজ। আর সেখানেই সাহিত্যের আশ্রয় নিতে হয়।... যুদ্ধের সময় জাতীয় সঙ্গীত (National Anthem) যে কাজ করে শান্তির কালে সাহিত্যও ঠিক সেই কাজ করে। যে জাতির পরিবর্ত্তন নাই, তার কোন ইতিহাস নাই। যে জাতিতে সাহিত্যচর্চা নাই তারা নিজেদের ইতিহাসের উপর সমাধিমন্দির তুলে দিয়েছে।"১৮
উল্লেখ্য যে, স্যার ফজলুর রহমান বাংলাদেশে উর্দুকে মাতৃভাষা করার বিরোধিতা করেছেন এবং তিনি বাংলা ভাষা চর্চার উপর গুরুত্বারোপ করেন।১৯
শিক্ষক হিসেবে আহমদ ফজলুর রহমান যেমন সাফল্য দেখিয়েছেন, তেমনি প্রশংসা কুড়িয়েছেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবে। আর উপাচার্য হিসেবে তিনি তো ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয়। দল - মত ও ধর্মীয় ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে তিনি ছিলেন সকলের কাছে প্রিয়। এ ব্যাপারে সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন, "ইংরেজি সাহিত্যের খ্যাতনামা অধ্যাপক অমলেন্দু বসু স্যার এ রফ রহমানকে আখ্যায়িত করেছেন ' মহাপ্রাণ ব্যক্তি' বলে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ইতিহাস ছাড়া যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস হতে পারে না, তেমনি স্যার আহমদ ফজলুর রহমানের জীবনকাহিনি ছাড়াও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ইতিহাস হতে পারে না। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও নয়।"২০
আহমদ ফজলুর রহমান ঐতিহাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেননি ; কিন্তু তিনি ছিলেন একজন সজ্জন ও বিদ্বান ব্যক্তি। ১৯৩৭ সালে তাঁকে সম্মানসূচক ডিগ্রি দেয়ার প্রাক্কালে তৎকালীন উপাচার্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মন্তব্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, "He rendered valuable services to the University, and by his charming personality and wise counsel and advice helped to solve many complicated problem that faced the University from time to time. His urbanity of manners and deep solicitude for the interest of the students made him a popular figure not only in the University but also in the whole of Dacca."২১
সুতরাং স্যার এ এফ রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবলমাত্র ইতিহাস বিভাগের রিডার কিংবা উপাচার্যই নন ; তিনি এমন এক আলোকবর্তিকা যার আলোয় আলোকিত হয়েছে তাঁর শিক্ষার্থী ও অনুরাগীরা। পরবর্তী সময়ে তা স্তিমিত না হয়ে আরো বেগবান ও গতিশীল হয়েছে যার রেশ রয়ে গেছে এখনও।
তথ্যসূত্র: ১.রতনলাল চক্রবর্ত্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ : ১৯২১ - ২০০০, ঢাকা, ২০০২,পৃ.১
২.সরদার ফজলুল করিম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ : অধ্যাপক রাজ্জাক এর আলাপচারিতা, ঢাকা ১৯৯৩,পরিশিষ্ট -১,পৃ.১৩১ - ১৩২
৩.ভবতোষ দত্ত, আটদশক, কলকাতা, ১৯৮৮,পৃ.৫৫
৪.Dacca Review, Vol.X, No.10, January, 1921,p.2
৫.সৈয়দ আবুল মকসুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা, ঢাকা, ২০১৮,পৃ.১১৩
৬.সৈয়দ আবুল মকসুদ, স্যার ফিলিপ হার্টগ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য, ঢাকা, ২০১৯,পৃ.১৫
৭.রতনলাল চক্রবর্ত্তী, প্রাগুক্ত, পৃ.৬১ - ৬২
৮.জনাব শামসুল হুদা সাহেবের নিকট লিখিত পত্র। এ পত্রের কপি ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ের দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ শাখায় রয়েছে।
৯.ড. রতনলাল চক্রবর্ত্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রন্থিত ইতিহাস, ঢাকা, ২০১৩,পৃ.২২
১০.February 25th, 26th,27th,D - Register, Bundle - 3M, Serial No.28,Dhaka University Record Room
১১.রতনলাল চক্রবর্ত্তী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রন্থিত ইতিহাস, প্রাগুক্ত, পৃ.৩৩
১২.প্রাগুক্ত, পৃ.৩৯
১৩.21 March, 1934,D - Register, Bundle - 10M, Serial No.192,Dhaka University Record Room.
১৪.রতনলাল চক্রবর্ত্তী, প্রাগুক্ত, পৃ.৪৭
১৫.16 November, D - Register, Bundle : 10M, Serial No: 192,Dhaka University Record Room
১৬.20 December,1934,pre - mentioned
১৭.শিখা, ৩য় বর্ষ, ১৯২৯,পৃ.১৬ - ১৭
১৮.অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হিসেবে স্যার আহমদ ফজলুর রহমানের ভাষণ, শিখা, ১ম বর্ষ, ১৯২৬,পৃ.২
১৯.প্রাগুক্ত, পৃ.৪
২০.সৈয়দ আবুল মকসুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা, প্রাগুক্ত, পৃ.২৭৫
২১.The Convocation Speeches, Vol.I, 1923 - 1946, Dhaka University, Dhaka, 1988,p.288
সুহৃদ সাদিক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন আপনার মতামত লিখুন