আশ্চর্য সুন্দর দুটি কৌতূহলী চোখ ছিল তার, আর ছিল নিষ্পাপ মায়াভরা মুখ। সে ছিল পড়ুয়া, সৃষ্টিশীল লেখক এবং দ্বিভাষী" />
ত্বকী পদকজয়ী লেখা: ২০১৮
আশ্চর্য সুন্দর দুটি কৌতূহলী চোখ ছিল তার, আর ছিল নিষ্পাপ মায়াভরা মুখ। সে ছিল পড়ুয়া, সৃষ্টিশীল লেখক এবং দ্বিভাষী অনুবাদক। বই পড়া আর ছবি আঁকা ছিল তার জীবন। তার নাম তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। জন্মেছিল নারায়ণগঞ্জে ১৯৯৫ সালের ৫ অক্টোবর বিকেলে। ডাক নাম ছিল ত্বকী, যার অর্থ আলো। মা রওনক রেহানা ও পিতা রাফিউর রাব্বির চোখের আলো ছিল সে। ফাল্গুনের এক বিকেলে (৬ মার্চ, ২০১৩) অপহরণের শিকার হয় ত্বকী। দুই দিন পর ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যায় লাশ ভেসে ওঠে তার। পৃথিবীতে তখন যেন আরো একটি কারবালা নেমে এসেছিল। শীতলক্ষ্যার দুই পার হয়ে গিয়েছিল ফোরাতের তীর। অসময়ে নিভে যায় মুক্তির আলো। এক স্বপ্নভরা চোখের অধিকারী ত্বকী হয়ে যায় কেবলই ছবি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মমতার শিকার ১৩ বছরের কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ক নাৎসিদের নির্যাতন কেন্দ্রে মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে জন্মদিনে পাওয়া ডায়েরিতে তিনি রেখে গেছেন সেই সময়ের দুঃসহ বর্ণনা। অন্যদিকে ত্বকী তার খেরোখাতায় লিখে গেছেন নিজের মনের নানা কথা। ডাক দিয়েছেন মৃত্যুকে জয় করার, স্বপ্ন দেখেছেন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার। লিখে গেছেন- “আমি হবো তাই, যা ছিল না কখনো কারো কল্পনা চিন্তায়।” সত্যিই ত্বকীর এমন পরিণতির কথা কারো চিন্তায় ছিল না। অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ লিখেছেন, ‘‘কে কতদিন বাঁচল তা দিয়ে জীবনের স্বার্থকতা প্রতিষ্ঠত হয় না। কে কত ভালভাবে-সৃজনশীলভাবে বাঁচল তা দিয়েই জীবনের সার্থকতা।’’ মাত্র ১৭ বছর পাঁচ মাসের আয়ুষ্কালের মধ্যেই ত্বকী প্রমাণ করেছে তার জন্ম সার্থক। ত্বকীর বাবা ত্বকীকে একজন অলরাউন্ডার করে গড়ে তুলেছিল। ত্বকী একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিল, ছিল রাজপথে অন্যায়ের প্রতিবাদে সরব এবং পড়ার টেবিলে মেধাবি। ২০১৩ সালে ত্বকী ব্রিটিশ কাউন্সিলের অধীনে এ-লেভেল প্রথম পর্বের পরীক্ষা দিয়ে পদার্থবিদ্যায় বিশ্বের সর্বোচ্চ নাম্বার ২৯৭/৩০০ এবং রসায়নে দেশের সর্বোচ্চ নাম্বার ২৯৪/৩০০ অর্জন করে। কিন্তু এ ফলাফল যতখনে প্রকাশ হয় ততখনে ত্বকী চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
দেশে এবং বিশ্বে রেকর্ড পরিমাণ নাম্বার পাওয়া নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের ব্যাপার। এর সঙ্গে আবৃত্তি, গান করা, ছবি আঁকা ও কবিতা লেখার গুণ ত্বকীকে সব্যসাচী রূপে প্রমাণ করে। কিন্তু তার এসব প্রতিভার চাইতেও আমার কাছে অধিক মূল্যবান মনে হয়েছে তার হীরে ঝলক চাহনী। তার চোখের ঝিলিক আমার হৃদয়টাকে হুহু করে কাঁদায়। তার ঘন কালো ভ্রু-তে মিশে আছে মায়াবি দৃষ্টির রহস্য, ত্বকীর ছবির দিকে তাকালে বারবার যেন আমিই শ্বাসরোধ হয়ে মারা যাই। এ চাহনি বড় নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক। তার সব প্রতিভা যেন লুকিয়ে আছে ওই দৃষ্টিতে।
কেন এই হত্যা: নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শামীম ওসমানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী জয় পান। আইভীর এই জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ত্বকীর বাবা রাফিউর রাব্বি। সেই সঙ্গে বাস ভাড়া বৃদ্ধিসহ আরো কিছু স্থানীয় সমস্যার প্রতিবাদ করায় তার সন্তানকে হত্যা করে পরাজয়ের ঝাল মিটিয়েছে সন্ত্রাসীরা। নারায়ণগঞ্জবাসী মনে করে, রাফিউর রাব্বিকে জব্দ ও শায়েস্তা করার জন্যই এই ঘৃণ্য জিঘাংসার চর্চা করা হয়েছে।
যেভাবে হত্যা: ২০১৪ সালে হত্যার রহস্য উদঘাটন করে র্যাব কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল কিভাবে কারা, কখন, কোথায় ত্বকীকে খুন করেছে। র্যাবের বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ত্বকী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী জাতীয় পার্টির এমপি নাসিম ওসমানের ছেলে ও শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমান। কিলিং মিশনে অংশ নেয় আজমেরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও নারায়ণগঞ্জ শহরের কুখ্যাত আরো ১০ সন্ত্রাসী। ইউসুফ হোসেন ওরফে বিলাই চক্ষু লিটন, কালাম শিকদার, মামুন, রাজীব ও জামশেদ মিলে আজমেরীর ব্যবহৃত গাড়িতে (এক্স ফিল্ডার) করে ত্বকীকে অপহরণ করে। সুধীজন পাঠাগারে যাবার আলোকিত পথ থেকে ত্বকীকে অপহরণ করার পর ওসমান পরিবারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘উইনার ফ্যাশনে’ নিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়। রাত ১১টার দিকে আজমেরীর উপস্থিতিতে ত্বকীকে নির্মমভাবে পেটানো হয়। এক পর্যায়ে কালাম শিকদার ত্বকীর বুকের ওপর উঠে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত হলে আজমেরীর নির্দেশ মত লাশ বস্তাবন্দী করে মধ্যরাতে ওই একই গাড়িতে করে ত্বকীর নিথর দেহ শহরের চারারগোপ এলাকার একটি ১৬ তলা ভবনের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়ি চালান আজমেরীর ড্রাইভার জামশেদ, তার পাশে বসে সুলতান শওকত ভ্রমর। আর গাড়ির পেছনে ছিল লিটন, রাজীব, কালাম শিকদার ও মামুন। ১৬তলা ভবনের সামনে থেকে ত্বকীর লাশ নৌকায় তুলে পানিতে ফেলে দেয়া হয়। কাজ শেষে উইনার ফ্যাশনে ফিরে আসার পর মিশন সফল করায় আজমেরী সবাইকে নিয়ে বিরিয়ানি ভোজের আয়োজন করে। এর দুদিন পর ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যার কুমুদিনী খাল থেকে ত্বকীর লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার কয়েক মাস পর র্যাব-১১-এর সদস্যরা শহরের কলেজ রোডে টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত আজমেরী ওসমানের অফিস ‘উইনার ফ্যাশনে’ অভিযান চালিয়ে রক্তমাখা জিন্স প্যান্ট, রক্তাক্ত গজারির লাঠি ও বস্তাবন্দী নাইলনের রশি উদ্ধার করে। দেয়ালে ও শোকেসে অসংখ্য গুলির আলামত পায়।
হত্যারহস্য উন্মোচন হওয়ার পর হত্যাকারীদের মধ্য থেকে লিটন ও ভ্রমর ১৬৪ ধারায় বিচারকের দরবারে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। আর সংবাদ সম্মেলনে প্রদান করা তথ্যকে র্যাব ‘খসড়া চার্জশিট’ দাবি করে দ্রুত সময়ের মধ্যেই আদালতে চূড়ান্ত চার্জশিট দেয়ার ঘোষণা প্রদান করে। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও কয়েক দফা বলেছেন দ্রুত চার্জশিট দেয়া হবে। কিন্তু সেই ‘দ্রুত সময়’ ছয় বছরেও ফুরালো না, বিচারকের টেবিলে অভিযোগপত্র পৌঁছালো না। অপেক্ষার দিন, মাস, বছর কাটতে কাটতে দীর্ঘসূত্রিতার দীর্ঘশ্বাসে এখন বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে, ত্বকীর বাবা-মার অসহ মানসিক যন্ত্রণা যেন বেড়েই চলছে। ত্বকীর পরিবারে শোক ফুরালেও তাদের দুঃখটা থেকে থেকে যাবে আজীবন।
সারাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কথা দিয়েছিলেন, এ হত্যার বিচার হবে। এর আগে তিনি বলেছেন, শিশু হত্যাকারীরা ঘৃণ্য জীব। কিন্তু আজমেরী ওসমানের পিতা নাসিম ওসমানের মৃত্যু পরবর্তী বক্তৃতায় জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওসমান পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। এর পরই রহস্যজনকভাবে ত্বকী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের উচ্চ মহল থেকে ত্বকী হত্যার বিচার বাধাগ্রস্থ করছে। এই অভিযোগ ওঠার পরেও সরকার যখন কোন সাড়া দিচ্ছে না, তখন অভিযোগের সত্যতা ও সরকার-প্রশাসন ও বিচার বিভাগের ‘ব্যর্থতা’ প্রমাণ করে। একই সঙ্গে সরকারের যে জবাবদিহিতা নেই, সেই বিষয়টিকেও সামনে নিয়ে আসে।
শাস্তি না হওয়ায় সন্ত্রাসীরা যেন মনের আনন্দে গেয়ে বেড়াচ্ছে ‘‘আছেন আমার মিনিস্টার, আছেন আমার গডফাদার! কোট-কাচারি-হাজত থেকে তিনি আমায় করবেন পার, আমি ক্যাডার তিনি জামিনদার!’’ খুনীরা আস্কারা পেয়ে প্রকাশ্য জনসভা থেকে উল্টো রাফিউর রাব্বিকে পোকামাকড়ের মতো পিষে ফেলতে চায়।
হন্তারকদের বিচার না হওয়ায় সাধারণ মানুষ ক্রমাগতই ভয়ে চুপসে যাচ্ছে। ত্বকী হত্যার মাত্র আট মাসের ব্যবধানে আরো ১১ শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে (ইন্ডিপেনডেন্ট নিউজ, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪)। ভিন্ন জেলার শিশুরা এখন নারয়ণগঞ্জ যেতে ভয় পায়। মানুষ খুন হয়ে গেছে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। অন্য বাবারা ত্বকীর মুখ দেখে এখন নিজের সন্তানকে নিয়ে ভয়ার্ত জীবন-যাপন করছে। সন্ত্রাসের ভয়ে তারা প্রতিবাদহীন নিভৃত জীবন বেছে নিয়েছে। যেখানে অত্যাচারী, খুনী-সন্ত্রাসীদের আত্মগোপনে যাওয়ার কথা, সেখানে ন্যায়বিচারের অভাবে উল্টো মজলুম মানুষেরা আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে।
মানীয় প্রধানমন্ত্রী, শেখ রাসেলের কথা নিশ্চয়ই আপনার মনে পড়ে। তার কথা ভেবে যদি আপনি ডুকরে কেঁদে থাকেন তাহলে শুচিস্নিগ্ধ কিশোর ত্বকীর পরিবারের ব্যথাও আপনার বোঝার কথা। মানুষ হত্যা করে বিরিয়ানি খেয়ে উল্লাস প্রকাশ করা জল্লাদদের বিচার নিশ্চিত করার কথা। তাহলে খুনীরা এখনো কি করে বিচারের বাইরে থাকে?
মৃত্যুর পর ত্বকীর প্রথম জন্মদিনে তার মা রওনক রেহানা লিখেছে, “অপরাধীরা চিহ্নিত হলো, তারপরেও অপরাধীরা ধরা পড়ল না, অভিযোগপত্র দেওয়া হল না। সব কিছু জানার পরেও সরকার অপরাধীদের পক্ষ নেয়, এটা কী করে সম্ভব। আমরা কি এমনই রাষ্ট্র চেয়েছিলাম? এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ?”
শিক্ষাবিদ শান্তনু কায়সার লিখেছেন, ‘‘একটি জাতির আশা-আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়ন করার জন্য বৈষম্যহীন রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার যে নিরন্তর সংগ্রাম তার নামই মুক্তিযুদ্ধ।’’ কিন্তু আমরা কোন ঘটনার বিচার পাই, কোনটার পাই না। আমরা দেখতে পাই, সিলেট ও খুলনায় দুই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের বিচার বছর ঘোরার আগেই হয়েছে। তখন সবাই আশাবাদী ছিল এবার হয়তো ত্বকীর খুনীদের বিচার হবে। কিন্তু হলো না। তাহলে কি আমরা বলতে পারি, প্রভাবশালী সন্ত্রাসীরা হত্যা করলে তার বিচার মিলবে না? আমরা দেখেছি, বিদেশ থেকে ধরে এনে কিশোর রাজনের হত্যাকারীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। অন্যদিকে ত্বকীর হত্যাকারীরা জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে। ত্বকী হত্যার বিচার না হওয়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ‘শিশু আইন ২০১৩’ লঙ্ঘিত হচ্ছে। একই সঙ্গে জাতিসংঘ ঘোষিত শিশু সনদের ৩৫ ধারায় শিশু নির্যাতন ও হত্যার বিচার সম্পন্ন করার যে তাগিদ দেয়া হয়েছে তাও অমান্য করা হয়েছে। এক কথায়, ‘আইন সবার জন্য সমান’ এই নীতির লঙ্ঘন করা হয়েছে। কারণ রাকিব-রাজন হত্যার বিচার দ্রুত হতে পারলে ত্বকী হত্যার বিচার কেন নয়? এসব প্রশ্ন আমাদের বলতে বাধ্য করে, ত্বকী হত্যাকাণ্ড একটি বিচারহীনতার প্রতীক।
সারাদেশে এখন এলাকা ভিত্তিক গডফাদারদের নিয়ন্ত্রণ চলে। নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবার, ফেনিতে হাজারী, লক্ষীপুরে আবু তাহের, কক্সবাজারে বদি এলাকাভিত্তিক এমন এক একজন গডফাদারদের যোগসাজশে চলে চাঁদাবাজী, খুন-খারাপি, চোরাচালান, ভূমি দখল, কালোবাজারী, টেন্ডারবাজীসহ নানা অপকর্ম ও অনিয়ম। এসব এলাকা ভিত্তিক গডফাদাররা বহু সন্ত্রাসী পালে। অনুগত সন্ত্রাসীদের দিয়েই তারা নানা অপকর্ম চালায়। ফলে মাঝেমধ্যে হত্যা বা অপকর্মের রহস্য উন্মোচন হলে ওই চ্যালা শিষ্যদের নাম প্রকাশ হয়। গডফাদাররা মূল কুশীলব হলেও তারা থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অথচ খুনী-সন্ত্রাসী-নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ এক সময় যুদ্ধ করেছে, দেশ স্বাধীন করেছে। সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেই আজকাল সন্ত্রাসীদের দুধ-কলা দিয়ে পুষে রেখে বৈষম্য জিইয়ে রাখা হচ্ছে। তাই সন্ত্রাস দমনের কথা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। কারণ সরকার নিজেই সন্ত্রাসের সঙ্গে সংসার করছে, তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। চুনোপুটি মেরে গডফাদার ছেড়ে আর যাই হোক সন্ত্রাস দমন সম্ভব নয়। বরং ওসব ভেল্কিবাজি, লেফাফাদুরস্ত কথাবার্তা।
গত ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পথ চলতে চলতে নারায়ণগঞ্জ থেকে আগত এক রিকশা চালকের সঙ্গে কথা হয় আমার। কথা প্রসঙ্গে চালক বললো, ‘নারায়ণগঞ্জ হল গুম-খুনের শহর, সব সময় ডরের মধ্যে থাকি।’ আরেকটা ঘটনা বলছি। আমার এক কলেজ বন্ধু স্যাটায়ার করে বলত, তার বাড়ি ‘গুমগঞ্জ’! সহপাঠী বন্ধুর এই পরিচয়টা নির্মম বেদনার বিষে ভরা। এই বেদনা যেন নিজের সমস্ত পরিচয়কে মুছে দিতে উদ্যত। আর তাই নারায়ণগঞ্জের নাম গুমগঞ্জ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যাচ্ছে। যদি এসব খুনিকে দলীয় দৃষ্টিতে না দেখে বিচার করা হত, তাহলে শুধু ত্বকী নয় বহু মানুষের প্রাণ বাঁচত। হত্যাকাণ্ডের আগে ঘাতকদের হাত কাঁপত। তা না হওয়ায় প্রতিনিয়ত মুক্তির চেতনার সলিল সমাধি হচ্ছে শীতলক্ষ্যায়। সমাজ-রাষ্ট্র জিম্মি হয়ে পড়ছে নিপীড়কদের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়া দেশে এখন সন্ত্রাসী-গডফাদারদের নৈরাজ্য, কথা বললেই মানুষ গুম-খুন হচ্ছে। ১৯৭১ সালেও বাতাসে লাশের গন্ধ ভেসেছে, শীতলক্ষ্যায় লাশ পড়েছে, এখনো তাই চলেছে। শীতলক্ষ্যার শীতল জলে আর কত লাশ ভেসে চলবে? হায়দার হোসেনের গান আর কত দিন গাইতে হবে-
স্বাধীনতা কি নিরীহ লোকের অকারণে প্রাণদণ্ড?
স্বাধীনতা কি পানির ট্যাঙ্কে গলিত লাশের গন্ধ?
স্বাধীনতা কি সন্ত্রাসী হাতে মারণাস্ত্রের গর্জন?
স্বাধীনতা কি অর্থের লোভে বিবেক বিসর্জন?
সমাজে যোগ্য-মেধাবী, সত্যের পক্ষে প্রতিবাদকারীকে কনুই মেরে ফেলে দেওয়া হয়, ক্ষমতার জোরে চলে সত্যকে মিথ্যা প্রমাণের তোড়জোড়। অর্থ ও পদের লোভে মিথ্যার পক্ষে সাফাই গায় জ্ঞানপাপীরা। শামসুর রাহমান লিখে গেছেন, উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ, এই অসুস্থ চলমানতা কবে থামবে?
ত্বকীর স্বপ্ন ছিল সে প্রকৌশলী হবে। আমরা বিশ্বখ্যাত স্থপতি ও পুরকৌশলী ফজলুর রহমান খানের নাম জানি। মাদারীপুরের এই সন্তানকে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলী বলা হয়। পৃথিবীর অন্যতম উচ্চ ভবন শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার (১৯৭৪ সালে নির্মিত এই ভবনটি প্রায় ৩০ বছর ধরে বিশ্বের উচ্চতম ভবন ছিলো। বর্তমানে এর নাম উইওলস টাওয়ার)-এর নকশা প্রণয়ন করেন। ত্বকী বেঁচে থাকলে হয়ত আমরা আরেকজন এফ আর খান পেতাম। যিনি হয়ত পূর্বের এফ আর খানকেও ছাড়িয়ে যেতেন। তার পরিচয়ে নতুন করে পরিচিত হত বাংলাদেশ। গর্ব করত দেশের প্রতিটি নাগরিক। জাতি হিসেবে অবস্থান হত উন্নত, স্থান হত সম্মানের। কিন্তু সেই সম্ভাবনার ফুল অকালে ঝড়ে গেল নরঘাতকের ইশারায়।
তুখোড় মেধার অধিকারী ত্বকীর ইচ্ছে ছিল সে বিদেশে থাকবে না। ২০১৭ সালের ২২ ফ্রেবুয়ারি ‘ভাঙ্গো দুর্দশার চক্র’ নামক নিজের লেখা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছিলেন, ‘‘বহু মানুষ বাংলাদেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। বহু মানুষ যাচ্ছেন চিরদিনের জন্য, আর আসবেন না। কিন্তু আমার ধারণা যে, কোন মানুষের মধ্যে যদি আলো থাকে, শাক্তি থাকে, প্রতিজ্ঞা থাকে; তিনি কখনোই সাধারণত দেশ ত্যাগ করেন না।...করলেও ফিরে আসেন।” ত্বকীর মধ্যে আলো ছিল বলেই সে প্রিয় জন্মভূমি ত্যাগ করতে চায়নি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস রাজনীতি না করেও তাকে নষ্ট রাজনীতির পাগলা ঘোড়ার দাপটে পিষ্ট হতে হল।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং তনু হত্যার রহস্য এখনো উদঘাটন করা হয়নি। শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফসহ রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে মুক্ত হয়ে গেছে খুনের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বহু আসামী। অপরাধের বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা সাহসী হয়ে উঠছে। প্রতিটা দিন সংবাদপত্রে রক্তপাতের ছবি দেখতে হচ্ছে। আন্দোলন, হরতাল, অবস্থান, অনশন, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, নৌবন্ধন, স্মারকলিপি, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, সেমিনার-সংবাদ সম্মেলনে এত কথকতার পরেও যদি বিচার না পাওয়া যায়, তবে যাদের হত্যার বিচারের দাবিতে কোন আন্দোলন হয় না, তারা কতটা ন্যায়বিচার পায়? আমরা কিছু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু বকর এবং পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ হত্যার বিচার হয়েছে। তবে যে বিচার হয়েছে তাকে প্রহসনই বলা চলে। তৃতীয় সেমিস্টার পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জনকারী শিক্ষার্থী আবু বকর ২০১০ সালে স্যার এ.এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এই হত্যাকাণ্ডের ৭ বছর পর আদালত অভিযুক্ত সবাইকে খালাস প্রদান করেন। দীর্ঘ আট মাস পর প্রথম আলো পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘আবু বকরকে কেউ খুন করেনি’ (২৬ জানুয়ারি ২০১৮)। অন্যদিকে বিশ্বজিতের খুনীদের বেশির ভাগই ছাড়া পেয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘প্রশ্ন’ কবিতার কথা যেন আজ নির্মম বাস্তবতা হয়ে ফিরে এসেছে, ‘‘আমি-যে দেখেছি, প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে/ বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে।” আর এমন বিচারের কারণেই হয়ত অসহায় কণ্ঠে অধ্যাপক আবুল কাশের ফজলুল হক তার ছেলে হারিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কোন হত্যাকাণ্ডের আমি আর বিচার চাই না।’’ সাংবাদিক নির্মল সেন দাবি তুলেছিলেন, “স¦াভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই।” এই অবিচারের দেশে এ দাবি নিষ্ফল আবেদন ছাড়া কিছুই না।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, “বাঁচতে হলে যে ব্যবস্থা মানুষের সঙ্গে শত্রুতা করে তাকে ভাঙতে হবে।” তাই আজ মাতৃভূমিকে বাসযোগ্য করতে হলে এই অচলায়তনকে ভাঙতে হবে। শতকরা ১ জনের বিরুদ্ধে শতকরা ৯৯ জনের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কণ্ঠে আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে, “এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ অঙ্গীকার।” আমরা যেন ন্যায়বিচার ও সুবিচারের জন্য শুধু আদালতের দিকে তাকিয়ে না থাকি। সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ যে লড়াই শুরু করেছে, সে লড়াইটা জাগরুক থাকুক। ১৯৫৫ সালে আমেরিকায় সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে এক কৃষাঙ্গ মায়ের একক আন্দোলন লাখো মানুষের সমর্থন পেয়েছিল। তীব্র আন্দোলনের মুখে শুধু বিচার নিশ্চিত নয়, সংবিধান পর্যন্ত বদলে যায়। রাফিউর রাব্বির নেতৃত্বে বাংলাদেশও তেমনি হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে হবে। রাষ্ট্রের আদালত থেকে আমরা যখন বিচার পাচ্ছি না, তখন সময় এসেছে জাহানারা ইমামের মত করে গণআদালত গঠন করে প্রকাশ্যে এ হত্যার রায় ঘোষণা করার।
ন্যায়যুদ্ধে ত্বকীকে জিততেই হবে। কারণ একজন শহীদের ময়নাতদন্ত কবিতায় কিশোর কবি ত্বকী লিখে গেছেন- “ওরা...হত্যা করে স্পন্দিত জীবন, যাতে স্পন্দনের শব্দ প্রতিবাদ হয়ে উঠতে না পারে।” তাই আমাদেরকে প্রমাণ করতে হবে হত্যা করে প্রতিবাদ থামানো যায় না, সত্যকে লুকায়িত করা যায় না। প্রস্তর খণ্ডে লিখে গেছেন “ভয় কিসের? দ্বিধা কেন মৃত্যুতে?” শেষ কথায় বলব, ত্বকী অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক নিরব আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবে। তার নামটি মৃত্যুপুরীর মুক্তি নিশান হয়ে থাকবে। তার এই প্রাণদান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘মানবতা ও মুক্তির জয়গান’ হয়ে সকল কিশোরের হৃদয়ে অনুরণ সৃষ্টি করে যাবে যুগের পর যুগ। ত্বকীর আত্মা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিবে “জীবন যেখানে দ্রোহের প্রতিশব্দ, মৃত্যুই সেখানে শেষ কথা নয়।”
আরও পড়ুন আপনার মতামত লিখুন