আশ্চর্য সুন্দর দুটি চোখ ছিল তার আর ছিল মায়াভরা মুখ। বন্ধুত্ব, বিশ্বাস ও নেতৃত্ব ছিল যার ছোট্ট জীবনের অনন্য অর্জন। বলছি শেখ রাসেলের কথা। স্কুলের খাতায় যার নাম ছিল শেখ রিসাল উদ্দিন। আজ তার বয়স ৫৮ বছর। অথচ তার মুখচ্ছবি আমাদের মানসপটে আটকে আছে সেই ১০ বছরে। দিন যায়, রাত আসে কিন্তু রাসেলের বয়স বাড়ে না। হয়ত বাড়ে না বলেই বাঙালি প্রতিটি শিশুর বন্ধু হয়ে রাসেল বেঁচে আছেন আজো।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মশিউর রহমান তার প্রবন্ধের শেষাংশে উল্লেখ করেছেন, ‘রাসেল আজ অবিচারের বিরুদ্ধে তীব্র স্লোগান’। আমার মনে হয়, শুধু স্লোগানই নয়, হত্যা ও শিশু নির্যাতন বিরোধীতার প্রতীকের নাম শেখ রাসেল, শান্তির প্রতীকের নাম শেখ রাসেল। ফজল-এ খোদা’র মত করে আমারো আজ বলতে ইচ্ছে করে-
“রাসেল এখন বিশ্ব শিশুর প্রতীক!
সব শিশুরই ঘাতকদের
ঘৃণা এবং ধিক।”
অবহেলিত, পশ্চাদপদ, অধিকারবঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হয়ে শেখ রাসেল আজ বাংলার শিশু-কিশোর-তরুণদের কাছে এক ভালবাসার নাম। দেশে ১৩ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। আজ নতুন করে আরো ৫ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব এবং তিনশ শেখ রাসেল স্কুল অব ফিউচার উদ্বোধন করবেন রাসেলেরই সেই প্রিয় হাসু আপা।
কবির ভাষায়, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’। তাই আজকের শিশুদের ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দক্ষ করে গড়ে তোলার সুযোগ নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন হাসু আপা।
যে আপা রাসেলকে মায়ের স্নেহে-আদরে বড় করে তুলেছিলেন। আর তাই মায়ের পর রাসেল সবচেয়ে ভালোবাসত ওর বড় আপাকে। প্রথম হাঁটতে শিখেছেও তার হাতেই। এমনকি রাসেলের জীবনের শেষ কথাগুলোতেও ছিল হাসু আপা কিংবা মায়ের কাছে যাবার মিনতি। আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম যিনি বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর বাড়ির রিসিপশনিস্ট ছিলেন তিনি এই নৃশংস ঘটনায় সাক্ষী। তার বর্ণনায় মৃত্যুর আগে রাসেল খুনিদের বলেছিল, “আল্লা’র দোহাই আমাকে প্রাণে মেরে ফেলবেন না। আমার হাসু আপা দুলাভাইয়ের সঙ্গে জার্মানিতে আছেন। আমি আপনাদের পায়ে পড়ি, দয়া করে আপনারা আমাকে জর্মানীতে তাদের কাছে পাঠিয়ে দিন। আমি মায়ের কাছে যাব, আমাকে মায়ের কাছে যেতে দিন।” নিষ্পাপ শিশুর এই আকুতিতেও খুনির মনে কোন দরদ জাগেনি।
২.
আমাদের রাসেল শান্তির প্রতীক পায়রাদের আদর করতেন। বঙ্গবন্ধু এবং বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিবও পায়রাদের অনেক ভালবাসতেন। বঙ্গমাতা খুব ভোরে উঠে ছোট ছেলে রাসেলকে কোলে নিয়ে কবুতরদের খাবার দিতেন। ফলে হাঁটতে শেখার আগে থেকেই পায়রাদের সাথে বন্ধুত্ব হয় রাসেলের। হাঁটতে শেখার পর নিজেই কবুতরের পেছনে ছুটত, নিজ হাতে খাবার দিত।
‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ স্মৃতি লেখায় রাসেলের প্রিয় হাসু আপা লিখেছেন, ‘‘আমাদের গ্রামের বাড়িতেও কবুতর ছিল। কবুতরের মাংস সবাই খেত। বিশেষ করে বর্ষাকালে যখন অধিকাংশ জায়গা পানির নিচে থাকত তখন তরিতরকারি ও মাছের বেশ অভাব দেখা দিত। তখন প্রায়ই কবুতর খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। সকালে নাস্তার জন্য পরোটা ও কবুতরের মাংস ভুনা সবার প্রিয় ছিল। তা ছাড়াও কারো অসুখ হলে কবুতরের মাংসের ঝোল খাওয়ানো হতো। ছোট বাচ্চাদের কবুতরের স্যুপ খাওয়াত। রাসেলকে কবুতর দিলে কোনদিন খেত না।” ছোট্ট জীবনে রাসেল যতদিন বেঁচে ছিল কখনো কবুতরের মাংস খাননি।
রাসেলের যে সময়ে জন্ম, সে কালের যুদ্ধবিরোধী শান্তি আন্দোলনের নেতা ছিলেন ব্রিটিশ দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ‘বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল’। এই বিশ্বকে মানুষের জন্য সুন্দর ও শান্তিময় বাসভূমি করার লক্ষ্যে এই মনীষী ছিলেন সদা সক্রিয়। ৫ হাজার মাইল দূরে বসে তার ভক্ত বনে গিয়েছিলেন শেখ মুজিব। এতটাই যে নিজ সন্তানের নাম রাখলেন রাসেলের নামে।
‘‘এই নাম রাখাটা তাঁর ক্ষেত্রে নামটি সুন্দর বলে রাখা নয়, পছন্দ হয়ে গেছে বলে রাখা নয়, এই নামটি বেছে নেয়ার পেছনে মানুষটির বিশ্বাস, আশা, কল্পনা, প্রত্যাশা ও স্বপ্ন যেনো জড়িয়ে ছিল এক মহৎ প্রত্যাশায়।’’
মাত্র ১০ বছর ৯ মাস ২৮ দিন বয়সী রাসেল তার ছোট্ট জীবনে কখনো বিশ্বাস ও বন্ধুত্বের ভঙ্গ করেননি। বাড়িতে পোষা কুকুরটির সঙ্গে বেশ ভাব জমেছিল রাসেলের। একদিন খেলতে খেলতে হঠাৎ টমি ঘেউ করে ডেকে ওঠায় রাসেল ভয় পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বোন শেখ রেহানার কাছে চলে যায় এবং বলে, টমি বকা দিচ্ছে! তার কথা শুনে বাড়ির সবাই হেসে উঠলো- ‘টমি আবার কীভাবে বকা দিল!’ বড় বোন শেখ হাসিনা ঘটনাটির স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘‘টমি তাকে বকা দিয়েছে এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না, কারণ টমিকে সে খুবই ভালবাসত। হাতে করে খাবার দিত। নিজের পছন্দমত খাবারগুলো টমিকে ভাগ দেবেই, কাজেই সেই টমি বকা দিলে দুঃখ তো পাবেই।’’
৩.
পিঁপড়ার কামড়ে ছোট্ট আঙ্গুল কেটে রক্ত বের হবার পর থেকে রাসেল কামড়ানো কালো পিঁপড়ার নাম দিয়েছিল ‘ভুট্টো’! শান্তি নষ্টকারী ও মানুষকে কষ্ট দেওয়া, রক্ত ঝড়ানো লোকটার নাম যে ভুট্টো, তা ওই ছোট্ট বয়সে কেমন করে অনুধাবন করেছিল রাসেল তা এক বিস্ময়।
শিশু বয়সেই তার নেতৃত্বগুণ বিকশিত হতে শুরু করে, যার পরিচয় ফুটে উঠেছিল টুঙ্গিপাড়ায় বন্ধুদের নিয়ে ক্ষুদে বাহিনী গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। রাসেল বড় হয়ে সেনা অফিসার হতে চেয়েছিল। কিন্তু হায় সে কী জানত তার ভালবাসার পেশার কিছু মানুষই তার স্বপ্নগুলো মুছে দিবে? ৩২ নম্বর ছিলো রাসেলের জীবনের প্রথম ও শেষ বাড়ি।
আপা কিংবা মায়ের কাছে যাবার যে আকুতি রাসেল জানিয়েছিল। তারপর এক খুনি আশ্বাস দিয়ে বলেছিল- ‘চল তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি’। বিশ্বাসী রাসেল খুনির হাত ধরে মায়ের কাছে যাবার সময় পাড়ি দিয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর কঠিন পথ। সে যাত্রায় রাসেলের পিছু নিয়েছিল তার প্রিয় টমি। মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে দিয়েছিল আজিজ পাশা। টমি নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে যায়। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের ৬৭৭ নম্বর বাড়ি থেকে চিরতরে পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে উড়ে যায় শান্তির পাখি পায়রা। আজ ৪৭ বছর হয়ে গেল তারা আর কোনদিন ফিরে আসেনি, কোনদিন না।
রক্ত সহ্য করতে না পারা রাসেলকে সেদিন একে একে ভাই, ভাবি, বাবার রক্তে ভেজা পিচ্ছিল পথ পাড়ি দিয়ে মায়ের কাছে যেতে হয়েছিল। শেখ রেহানার লেখায়, ‘‘রাজনীতি কী, ও কী বুঝত? রক্ত দেখলে চোখ বন্ধ করে ফেলত। গোলাগুলির শব্দ শুনলে মাকে জড়িয়ে ধরত,....সেই রাসেল সবার রক্ত দেখে দেখে তারপর নিজের রক্ত দিয়ে গেল।...রাসেল আমাদের ব্যথা, আমাদের শোক এবং আমাদের ভালবাসা।’’
ফুফাত ভাই আরিফ ছিল রাসেলের খুব ভাল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা দুজনে একই স্কুলে পড়ত এবং এক সঙ্গে খেলত। সেই আরিফও ১৫ আগস্ট রাসেলের সঙ্গেই ঘাতকদের নিষ্ঠুর বুলেটে নির্মমভাবে নিহত হন। ‘‘`শিশু রাসেল যে ছোট্ট সাইকেলটি চালাতো হাসিমুখে, সেটি আজো খাঁখাঁ দাঁড়িয়ে আছে ৩২ নম্বর বাড়ির এক কোণে। কেউ আর সেই শূন্য আসন পূর্ণ করবে না।”
এভাবে খেলার সাথী, খেলনা, প্রিয় পোষা টমি, পায়রা, বাবা-মা আর স্বজন সবাইকে নিয়ে বাঙালির বুকে শোক হয়ে রয়ে গেছে রাসেল। এক পৃথিবী কান্না হয়ে রাসেল মাটির নিচে শুয়ে আছে, মায়ের কাছাকাছি। বনানী গোরস্থানে ছোট্ট একটুখানি জায়গা নিয়ে, গত ৪৭ বছর ধরে।
এতদিনে পাল্টে গেছে পৃথিবীর অনেক কিছুই, মুছে গেছে রাসেলের গা থেকে চুইয়ে পড়া তাজা রক্তের দাগ। কিন্তু কোন দিন মুছে যাবে না এই বেদনা-বিদুর ইতিহাস। শিশুরা শান্তির দূত তাই শেখ রাসেল ও বার্ট্রান্ড রাসেল যেন সমার্থক হয়ে রবে আমাদের হৃদয়ে।